শ্রীমৎ বিশুদ্ধানন্দ পরমহংস ১৮৫৩ সালের মার্চ মাসে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পূর্ব বর্ধমান জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। জন্মকালীন এর নাম রাখা হয়েছিল ভোলানাথ চট্টোপাধ্যায়, পরবর্তীকালে তাকে বিশুদ্ধানন্দ পরমহংস নামে অভিহিত করা হয়। তিনি একদিকে ছিলেন যেমন যোগী, তেমনি অপরদিকে ছিলেন একজন আধ্যাত্মিক ধর্মগুরু। ইনি একজন আধিকারিক মহাপুরুষ ছিলেন। অবশেষে উনি 1937 সালের জুলাই মাসে কলকাতায় মারা যান। এনার কিছু উপদেশ নিছে উল্লেখ করা হলো।-
“জ্ঞান, কর্ম, অনুভূতি, সুখ-দুঃখ ভোগ যা কিছু আমাদের ঘটছে, কিছুই লুপ্ত হয় না। লিঙ্গ (সূক্ষ্ম) দেহে সবই সংস্কাররূপে বর্তমান থাকে। (জন্মান্তরী জীবের) স্থূলদেহের পরিবর্তন হয় বটে, কিন্তু লিঙ্গদেহ একই থাকে। (বস্ত্রগ্রহণ ও ত্যাগের মতোই জীবের লিঙ্গদেহ) স্থূলদেহ গ্রহণ ও ত্যাগ (করে)। ওটি বস্তুতঃ জীবের
জন্ম ও মৃত্যু নয়। সকল জীবের লিঙ্গদেহের একবারই জন্ম। এবং একবারই মৃত্যু হয়। (জীবরূপে) এই লিঙ্গদেহ গ্রহণই ‘জন্ম’। এটি বস্তুতঃ (প্রতি জীবের) একবার হয় বলে তখন জন্মও এক ভিন্ন অধিক মনে হয় না। লিঙ্গদেহ গ্রহণ থেকে ত্যাগ পর্যন্ত জীবের (প্রকৃত) জীবন-আয়ু। লিঙ্গদেহ ত্যাগই মৃত্যু (যা আসলে জীবাবস্থার সমাপ্তি, স্বরূপবোধে বিদেহমুক্তি)। স্বরূপতঃ কেউ মরে না, কেউ বাঁচে না, মরা-বাঁচা স্থূলের খেলা।”
“শুদ্ধ ব্রহ্মসত্তাতে ‘আমিত্ব’ নেই। ভাবকে আশ্রয় না করে ‘আমিত্ব’ অনুভব জাগে না। …(জীবের) মুক্তাবস্থায় বিশুদ্ধ ‘আমি’ বোধ থাকে, এটি ব্রহ্মাশ্রয়ে প্রকাশমান হয়। …..ব্রহ্ম যেমন ব্যাপক ….এই ‘আমিও তেমনই হয়।”
“মনুষ্যজন্মই শ্রেষ্ঠ, মোক্ষ কেবল এই জন্মেই কর্মদ্বারা লাভ করা যায়। মনুষ্যজন্ম-এর পূর্বের স্থাবর-জঙ্গম ইত্যাদি বিভিন্ন প্রজাতিতে জীবের যে জন্ম তা ‘কর্ম-জন্য’ নয়, মনুষ্যজন্মের পূর্বে কর্মের অধিকার হয় না। তার পূর্বে যে চুরাশি লক্ষ জন্ম, স্বভাবের নিয়মেই জীবকে তার মধ্যে দিয়ে আসতে হয়।”
“মুক্ত হলেও জীব জীবই থাকে,…..তবে তাতে ব্রহ্ম-ভাবের বিকাশ হয়। তোমার দেহও…. তোমার নিজের নয়….তা প্রাকৃতিক নিয়মে চালিত হয় । জগতের অন্যান্য সকল বস্তুই এই দেহ, মন ও ইন্দ্রিয় দ্বারা তোমার সঙ্গে সম্বন্ধ। ….. বস্তুতঃ তোমার (অহংগত) নিজস্ব বলতে সত্য সত্যই কিছু নেই। তুমি আবার কী ত্যাগ করবে? ….মন নিরাসক্ত ও নির্বিষয় হলে সংসারের সুখ-দুঃখ ভোগ করতে হয় না।”
“সংসারে যাবতীয় বস্তু ভগবান দিয়েছেন, পার্থিব ভালোবাসার মধ্য দিয়ে তাঁকেই ভালোবাসার জন্য । …..ভক্তির গাঢ় অবস্থাকে প্রেম বলে। এই অবস্থা পূর্ণত্বের দ্বারদেশ । মহাশক্তি যা অসীমতত্ত্বে প্রবেশের মুখ। এরপরই অকুল পাথার, যেখানে অকুল পাথার, সেখানে বাক্য বা মনের গতি নেই…. দ্বৈত-অদ্বৈত কিছুই নেই, এক হিসেবে ঈশ্বর তত্ত্বেরও অতীত অবস্থা—পূর্ণতমা মহাশক্তির স্বরূপ বা স্ব-ভাব। বিনা প্রেমে এই পূর্ণত্বে প্রবেশ হয় না।”
“জগৎময় এক মহামায়ার মহাশক্তি কাজ করছে, অথচ নানা দ্রব্য ও জীববিশেষে শক্তি ভাব-ক্রিয়াদির নিয়ম আলাদা। বস্তুতঃ জড়বস্তু চিৎশক্তিরই বিক্ষিপ্ত ও আচ্ছন্ন অবস্থা মাত্র।”
“যে আলো জগতের সর্বত্র সমভাবে বর্তমান, তা থেকে অন্ধকার দূর হয় না। কারণ তা অন্ধকারেও বর্তমান আছে। অন্ধকার দূর করতে হলে অভিব্যক্ত আলোর আবশ্যকতা। সেই রকম সর্বব্যাপক বিশুদ্ধচৈতন্য থেকে জীবের অজ্ঞান নিবৃত্তি হয় না। যদিও পরমাত্মারূপে তা জীবেও আছে বটে, তথাপি তা অজ্ঞান নিবর্তক নয়। এই বিশুদ্ধচৈতন্য যে আধারে জ্ঞান বা বিদ্যারূপে অভিব্যক্ত হয়ে আছে, সেখান থেকে জ্ঞান সংগ্রহ করে অজ্ঞানের নাশ করতে হবে। যে আধারে জ্ঞান উজ্জ্বলভাবে জ্বলছে তাকেই ‘গুরু’ বলে। ওই সংস্পর্শে যখন জীবের আধারেও সুপ্ত অগ্নি জ্বলে ওঠে, তখন তার অন্তরাত্মা জেগে ওঠে। তখন ভেতরেই গুরুকে পাওয়া যায়।”
“জগদম্বাই সব। তাঁর ইচ্ছায় সব হয়। ‘আমি-আমার’ এসব কিছু নয়। কৃষ্ণ বলো, বিষ্ণু বলো সবই এক মহাশক্তি হতে।……ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব থাকেন প্রকৃতি ধ্যানে। …. প্রকৃতি হচ্ছেন চৈতন্যরূপা আদি জননীশক্তি – আদ্যশক্তি।”
“পূর্বজন্মের (‘ভালো-মন্দ’) যা অগোচর, তা নিয়ে বৃথা চিন্তায় লাভ কী?… বর্তমান মুহূর্তে নবীন কর্মে প্রবৃত্ত হতে হবে।….. কোনো স্থলেই সাধু চেষ্টা বিফল হবার নয়। শুভকর্ম অল্প হলেও কল্যাণ করে থাকে। যে শক্তি ঈশ্বরে আছে, তা-ই জীবে আছে। কিন্তু ঈশ্বরে সে শক্তি প্রকট, কার্যকারণ সমর্থ, অভিব্যক্তি, জীবে তা অপ্রকট, নিষ্কিয়, জড়ত্বের ভাবে অবসাদগ্রস্ত। তার বলাধান করতে হলে……বাইরে থেকে করতে হবে। ওই শক্তিকে কুণ্ডলিনী শক্তি বলে।….কুণ্ডলিনী নিদ্রিত থাকা পর্যন্ত জীবের বদ্ধতা।”
“যিনি ব্যুথান ও নিরোধ, দ্বৈত ও অদ্বৈত এবং সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয় উভয় অবস্থার অতীত, তিনি সর্বাবস্থায় সর্বভাবে অসঙ্গরূপেই বিদ্যমান থাকেন। (স্বরূপতঃ) নিজের এই অবস্থার উপলব্ধি করাই অতিসিদ্ধির লক্ষণ।”
“সব রসই তো এক মূল হতে আসে। রস শুদ্ধ করে নিয়ে তার দ্বারাই রস স্বরূপের কাছে যাওয়া যায়।”
“পরমেশ্বরই গুরু।…..তাঁর স্বরূপভূত কৃপাশক্তি, তাঁরই ইচ্ছায় নেমে এসে জীবকে তদ্ভাবে ভাবিত করে নেয়, পরে জীবকে শোধিত করে স্বরূপে পৌঁছে দেয়। যে স্বচ্ছ আধার অবলম্বনে এই কৃপাশক্তি প্রকাশিত হয়, তাকেই গুরু বলে। সুতরাং একমাত্র ঈশ্বরই গুরু।”
“রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ-শব্দ সবই মায়ার খেলা। মায়ার ওপরে গেলে এসব কিছুই থাকে না। থাকে একটি অনির্বচনীয় অনুভূতি মাত্ৰ।”
“জ্ঞান ভিন্ন মুক্তি নেই। তবে তা শুদ্ধ জ্ঞান নয়, যথার্থ অপরোক্ষ জ্ঞান। যখন পাপ-পূণ্য বিগলিত হয়, সুখ-দুঃখ (দ্বন্দ্ব) অতিক্রান্ত হয়। জড়ীয় অভাব ও ত্রিতাপ জ্বালা নিবৃত্ত হয়। তখনই…… হৃদয়ে অহেতুক ভক্তির উদয় হয়ে থাকে। মুক্তির পূর্বে পরাভক্তির উদয়ই হতে পারে না।”
“জীব অভিমানবশতঃ নিজেকে ‘কর্তা’ মনে করে, তাই তার কর্মে ফলাফল ভোগ হয়।…..জীব যখন নিজেকে সর্বাংশে আশ্রিত বলে বোঝে, (সাক্ষীত্বে) স্ব-ভাবস্থ বলে বোধ করে, তখন তার কর্তৃত্ব থাকে না বলে ভোগও থাকে না। যতক্ষণ অহংকার বিগলিত না হচ্ছে, ততক্ষণ জোর করে পূণ্য-পাপের অতীত হওয়া যায় না।”
“ভাবপ্রবণতায় প্রকৃত লাভ বা উপকার কিছুই হয় না, বরং মন দুর্বল হয়। বিনা কর্মে কিছু হয় না। …..কর্ম থেকে জ্ঞান, ভক্তি, প্রেম পর-পর আসে।”