শ্রীমত রামপ্রসাদ ১৭২৩ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন একজন তৎকালীন বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্যিক, এবং ঈশ্বর প্রেমিক। ইনি ১৮০৩ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এনার কিছু উপদেশ নীচে উল্লেখ করা হলো।-
“ভেবে দেখো মন, কেউ কারো নয়। মিছে ফেরো ভূমন্ডলে। … দিন দু-দিনের জন্য ভবে, ‘কর্তা’ বোলে সবাই বলে। আবার সে ‘কর্তা’রে দেবে ফেলে। কালাকালের কর্তা এলে। যার জন্য মরো ভেবে, সে কি সঙ্গে যাবে চলে ?”
“অপার সংসার, নাহি পারাপার, ভরসা শ্রীপদ, সঙ্গের সম্পদ, বিপদে তারিণী করোগো নিস্তার। …এ ভব বন্ধন করো বিমোচন, মা বিনে তারিণী কারে দিব ভার।”
“জ্ঞানাগ্নি জ্বালিয়া কেন ব্রহ্মময়ীর রূপ দেখ না! – সাকারে সাযুজ্য হবে নির্বাণে কী গুণ বলো না। —কালী যার হৃদে জাগে, তর্ক তার লাগে কোথা? – যে যে ভাবের বিষয়, ভাব ব্যতীত অভাবে কি ধরতে পারে! – ত্যাজিব সব ভেদাভেদ ঘুচে যাবে মনের খেদ… — মা বিরাজে সর্বঘটে, তারা আমার নিরাকার।”
“মায়ার এ পরম কৌতুক। মায়াবদ্ধ জনে ধাবিত। অবদ্ধ জনে লুটে সুখ। ‘আমি’ এই ‘আমার’ এই—এভাব ভাবে মূর্খ সেই। মনরে, ওরে মিছামিছি সার ভেবে, সাহসে বাঁধছি বুক। আমি কে বা তোমার কে বা? মন রে, ওরে কে করে কাহার সেবা? মিছা ভাবো সুখ-দুঃখ। দীপ জ্বেলে আঁধার ঘরে দ্রব্য যদি পায় করে (হাতে) মন রে, ওরে তখনি নির্বাণ করে না রাখেরে এতটুকু। প্রাজ্ঞ অট্টালিকায় থাকো, আপনি আপনা দেখো। রামপ্রসাদ বলে মশারী তুলে দেখরে আপনার মুখ।”
“ও মন, ভাবো শক্তি, পাবে মুক্তি। বাঁধো দিয়ে ভক্তি দড়া। নয় বা থাকতে না দেখলো মন, কেমন তোমার কপালপোড়া।—যে-ই ধ্যানে (থাকে) এক মনে, সে-ই পাবে না তোমায় তাড়াতাড়ি।”
“ওরে মন বলি, ভজ কালী, – ইচ্ছা হয় যেই আচারে। সদা গুরুদত্ত মন্ত্র করো, দিবানিশি জপ করো। শয়নে প্রণাম জ্ঞান, নিদ্রায় করো মাকে ধ্যান। ওরে নগর ফিরো, মনে করো প্রদক্ষিণ শ্যামা মা-রে। যত শোন কর্ণপটে, সকলি মায়ের মন্ত্র বটে। কালী পঞ্চাশৎ বর্ণময়ী, বর্ণে বর্ণে নাম ধরে। কৌতুকে রামপ্রসাদ বটে, ব্রহ্মময়ী সর্বঘটে। ওরে আহার করো, মনে করো আহুতি দিই শ্যামা মা-রে।”
“মন রে! কৃষি কাজ জানো না? এমন মানব জমিন রইল পতিত, আবাদ করলে, ফলতো সোনা । কালী নামে দাওরে বেড়া, ফসলে তছরূপ হবে না। সে যে মুক্তকেশীর শক্ত বেড়া। তার কাছেতে যম ঘেঁসে না । গুরুদত্ত বীজ রোপণ করে, ভক্তিবারি তাই সেচো না। ওরে একা যদি না পারিস মন, রামপ্রসাদকে সঙ্গে নে না।”
“কাজ কী রে মন, যেয়ে কাশী। কালীর চরণ কৈবল্যরাশি। সার্ধ ত্রিশ কোটি তীর্থ, মায়ের ও চরণবাসী। হৃৎকমলে ভাবো বসে, চতুভুজা মুক্তকেশী। রামপ্রসাদ এই ঘরে বসে পাবে কাশী দিবানিশি।”
“কে জানে রে কালী কেমন! ষড়দর্শনে না পাই দর্শন। কালী পদ্মবনে হংস সনে, হংসীরূপে করে রমণ। তাঁকে মূলাধারে সহস্রারে, সদাযোগী করে মনন। আত্মারামের আত্মাকালী, প্রমাণ প্রণবের মতন। “তারা” ঘটে ঘটে বিরাজ করেন, – ইচ্ছাময়ীর ইচ্ছা যেমন, মায়ের উদর ব্রহ্মাণ্ড ভাণ্ড, প্রকাণ্ড—তা জানো কেমন? মহাকাল জেনেছেন কালীর মর্ম।
অন্য কে বা জানে তেমন। প্রসাদ ভাষে লোক হাসে। সন্তরণে সিন্ধগমন। আমার প্রাণ বুঝেছে, মন বোঝে না; ধরবে শশী হয়ে বামন! কেবল আসার আসা, ভাবে আসা, আসা মাত্র হলো। …রামপ্রসাদ বলে ভবের খেলায়, যা হবার তা-ই হলো। এখন সন্ধ্যাবেলায় কোলের ছেলে, ঘরে …নিয়ে চলো ৷”
“অশুচি—শুচিকে লয়ে দিব্য ঘরে কর শোভা। যদি দুই সতীনে পীরিত হয়, তবে শ্যামা মাকে পাবা। ধর্মাধর্ম দুটো অজা তুচ্ছ খোঁটায় বেঁধে থোবা, ওরে জ্ঞান খড়্গগে বলিদান, করিলে কৈবল্য পাবা।”
“তোমার কে মা বুঝবে লীলে (লীলা) তুমি কি নিলে, কী ফিরিয়ে দিলে। তুমি দিয়ে, নিচ্ছে। তুমি বাছ রাখো না সাঁঝ সকালে। তোমার অসীম কার্য – অনিবার্য। মাপাও যেমন যার কপালে।”
“এবার ভালো ভাব পেয়েছি। কালীর অভয়পদে প্রাণ সঁপেছি। – তাই রাগ-দ্বেষ লোভ ত্যাজে সত্ত্বগুণে মন দিয়েছি। তাঁর নাম সারাৎসার, আত্মশিখায় বাঁধিয়াছি।”
“মন কেন তোর ভ্রম গেলো না? – ওরে ত্রিভুবন যে. মায়ের মূর্তি জেনেও কি মন তা-ই জানো না। জগৎকে পালিছেন যে মা জানো না?”
“ওরে, সকলের মূল ভক্তি। মুক্তি হয় (মন) তার দাসী। নির্বাণে কী আছে ফল, জলেতে মিশায় জল। ওরে চিনি হওয়া ভালো নয়, চিনি খেতে ভালোবাসি।”
“ডুব দে মন ‘কালী’ বোলে, হৃদি-রত্নাকরের অগাধ জলে। রত্নাকর নয় শূন্য কখনো। দু-চার ডুবে ধন না পেলে, তুমি দম-সামর্থ্যে এক ডুবে যাও, কুল-কুণ্ডলিনীর কূলে। জ্ঞান-সমুদ্রের মাজে রে মন, শক্তিরূপা মুক্তা ফলে।
তুমি ভক্তি করে কুড়ায়ে পাবে, শিবযুক্তি মতন চাইলে। কামাদি ছয় কুম্ভীর আছে, আহার লোভে সদাই চলে। তুমি বিবেক – হদি গায়ে মেখে যাও; (ওরা) ছোঁবে না তার গন্ধ পেলে। রতন-মাণিক্য কত পড়ে আছে সেই জলে। রামপ্রসাদ বলে, ঝাঁপ দিলে মন, মিলবে রতন ফলে ফলে।”