শ্রীমৎ সহজানন্দ স্বামীনারায়ণ ১৮৭১ সালের এপ্রিল মাসে বর্তমান ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যে এক ব্রাহ্মণ পরিবারের জন্মগ্রহণ করেছিলেন। শৈশবকালে তিনি ঘনশ্যাম পান্ডে নামে পরিচিত ছিলেন। ইনি স্বামী রামানন্দের একজন বিশিষ্ট শিষ্য ছিলেন। পরবর্তীকালে ১৮০২ সালে যখন উদ্ধব সমাজের নেতৃত্ব পান, তখন তিনি সহজানন্দ স্বামীনারায়ণ নামে পরিচিত হন। তিনি বিশিষ্ট দ্বৈতবাদী বৈষ্ণম ব্যক্তিত্ব ছিলেন। আবার তিনি একজন সমাজ সংস্কারক মহামানব ছিলেন। অবশেষে ইনি ১৮০৩ সালের জুন মাসে বর্তমান ভারতের গুজরাট রাজ্যে শেষ জীবন ত্যাগ করেন। এনার কিছু উপদেশ নিচে উল্লেখ করা হলো।-
“রোজ সকালে জাগ্রত হয়ে প্রভু স্মরণ করবে। মায়া বন্ধন থেকে মুক্তির জন্য, অনন্য ভক্তি সহকারে পরমেশ্বরের পূজা উপাসনা করবে। সকল ধর্মস্থানে প্রণতি জ্ঞাপন করবে।”
“প্রাকৃতিক, মানবীয় বা রোগজনিত আপদ বিপদে নিজেকে ও অপরকে রক্ষার প্রয়াসে সাবধান হবে। দুষ্টব্যক্তি যদি অপমান বা উপেক্ষা করে, সহনশীল হয়ো, ক্ষমা করো, তার হিত কামনা করো। সর্বদা, সহিষ্ণু, আশাবাদী ও ধৈর্যবান হয়ো। অহিংসা হলো শ্রেষ্ঠ নৈতিকতা। (অন্যায়ভাবে) কোথাও অসম্মানিত হলে সেই স্থান ত্যাগ করা উচিত। ভবিষ্যতের আকস্মিক বা সংকট কালের জন্য অর্থ, দ্রব্য ও শস্য সঞ্চয় করা উচিত। সামর্থানুযায়ী উপযুক্ত ব্যক্তির প্রতি উদারভাবে দানী হও । সামাজিক রীতিনীতি অনুসারে যথাযোগ্য ভাবে মানুষের সঙ্গে সাদরে ব্যবহার করো। মিষ্টভাষী হও। গুণী ও গুরুজনদের সম্মান করো। অতিথি ও আশ্রিতের প্রতি যথাসম্ভব যত্ন নাও। সাথী ও সহযোগীদের বিপদে দুঃখে সেবা করো। অন্যের দোষ না দেখে গুণ দেখো। প্রশাসনে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করো। বিচারকালে ঠিকঠাকভাবে দোষগুণ দেখে ক্ষমতা ব্যবহার করো। সর্বদা গর্ব ও অহমিকা ত্যাগ করো। চিত্ত-রিপু, ক্রোধ, মান, লোভ, কাম-লালসা দমন করবে। রসনাকে নিয়ন্ত্রণে রাখবে। সুখভোগ ও চাহিদা ন্যূনতম রাখবে।”
“জীবের বোধশক্তি তার আপাদমস্তক জুড়ে সক্রিয় হয়। প্রতিটি ইন্দ্রিয়ের ক্রিয়া জীবের বোধশক্তিতে অনুভূত হয়। এই বোধশক্তির কেন্দ্রেই ‘জীবত্বে’র অধিষ্ঠান। তাই এই বোধশক্তিতে প্রাপ্ত অনুভূতি জীবের ‘আমিত্বে’র বোধকে আশ্রয় করে প্রকাশিত হয়। যেহেতু এই জীবত্বের মূলে রয়েছে ‘সাক্ষীত্ব’ বোধ, তাই ওই ‘সাক্ষীত্বে’র বোধকে আশ্রয় করেই প্রকাশিত হয় ‘জীবত্ব’।”
“পরব্রহ্ম মানে পরমেশ্বর ভগবান। তিনি সর্বশক্তিমান, অখণ্ড, সর্বজীবে তাঁর বাস। নিয়ন্তা, শাসকরূপী তিনি অন্তর্যামীরূপে সর্বজীবে আছেন, তিনি সর্বোপরি পুরুষোত্তম, সকল যোগ ও উপাসনার পরম লক্ষ্য তিনিই।”
“ধর্মরহিত কোনো কাজ বহুফলপ্রদ হলেও করো না। লোভ বা স্বার্থান্ধ হয়ে কখনো সদাচার ত্যাগ করো না। জুয়া খেলা বা চুরি পরোপকার হলেও করবে না। বিচার-বিবেচনা না করে হঠাৎ কোনো কাজ করবে না স্বার্থসিদ্ধির জন্য অন্যের সম্পর্কে মিথ্যা অপবাদ দেবে না। কখনো সঘাতকতা করবে না। ঘুষ নেবে না। কখনো কারোর গোপন কথা অন্যের কাছে বোলো না। সত্য বলো, কিন্তু অপরের শুধু অনিষ্টই করে, কারোরই মঙ্গল করে না, এমন কথা সত্য হলেও বোলো না। কাউকে অমার্জিত ভাষায় তিরস্কারও করো না। যে কাজে যার যোগ্যতার অভাব, সে কাজে তাকে প্রবৃত্ত করো না। মাদক সেবন করবে না। পরিবেশকে দূষিত করো না। অকৃতজ্ঞ, ব্যভিচারী, প্রতারক, লম্পট, কপট, নির্লজ্জ, দুষ্ট, ঠগ ও নীতিহীন অধর্মাচারীর সঙ্গ করো না। কখনো ষড়যন্ত্র করো না। পরনিন্দা করো না। অন্য ধর্মের নিন্দা করো না। নিরর্থক কথায় বা নিষ্ফল প্রবৃত্তিতে সময় ব্যয় করো না। যৌনোত্তেজক সাজ-পোষাক পরিধান করো না। কঠিন পরিস্থিতিতেও কর্তব্যকর্মে শিথিল হয়ো না। বিবেকহীন, পাষণ্ড, সিদ্ধান্তহীন, অ-জ্ঞানী বা নাস্তিকের আলোচনা শুনে বা তাদের নিন্দার ভয়ে কখনো শ্রদ্ধা-ভক্তি পূজা ত্যাগ করো না। নিজের গুণগান করো না। তুমি নিজে অনুচিত আচরণ করে ফেললে বা পাপ করলে কিংবা (নিজের ওপর) ক্রোধে বা বিরক্তবশতঃ উত্তেজনায় বা প্রায়শ্চিত্তরূপে নিজের শরীরে নির্যাতন করো না বা আত্মঘাতী হতে চেয়ো না ।”
” ‘মায়া’ অর্থাৎ ত্রিগুণত্মিকা প্রকৃতি—সত্ত্ব, রজো ও তমোগুণ তার স্বভাবগত। মায়াশক্তি ভগবানের সঙ্গে অভিন্নভাবে আছে।”
“সর্বকর্মের একমাত্র কর্তারূপে (অখণ্ডেশ্বর) ব্রহ্মকে উপলব্ধিই মুক্তির সর্বোত্তম উপায়। কোনো মানুষ যদি, তাঁকেই সর্বকর্মের কর্তারূপে বোঝে, সে তারপর আর কোনো তপস্যা না করে, তাহলেও সে জন্ম-মৃত্যুর চক্রবন্ধন অতিক্রম করে যায়।”
“নিত্য নাম জপ প্রার্থনা করো, ধর্মগ্রন্থ পাঠ করো; তারপর দৈনন্দিন কাজ শুরু করো। সর্বকর্মে ভগবানের প্রতি মন রেখে সব কাজ করো এবং ভগবানের প্রতি নিবেদিত বোধে মানবকল্যাণে সেবাকর্ম করো।”
“শুধু স্বধর্মপালন করলেই ভগবভক্তের হৃদয়গত পূর্ণতা আসতে পারে না। আত্ম উপলব্ধি এবং শ্রীভগবানের মাহাত্ম্যবোধের অনুভবের মধ্য দিয়েই তার পূর্ণতা ঘটতে পারে সার্থকভাবে।”
“জীব, ঈশ্বর মায়া (প্রকৃতি) অক্ষর ব্রহ্ম এবং পরব্রহ্ম পরমাত্মাকে যথার্থভাবে জানাকে জ্ঞান বলে। ‘জীব’ মানে পরমাণুর মতো অতি সূক্ষ্ম, অগোচর, অবিভাজ্য, অবিনাশী চৈতন্যতত্ত্ব (চিৎশক্তি কণা) যেটি প্রতি জীবিত প্রাণীতে ভিন্ন ভিন্ন থাকে। সে স্বতন্ত্র বোধশক্তিযুক্ত সমগ্র জীবশরীরে বোধ রূপে ব্যাপ্ত।”
“পরমসত্তা পরব্রহ্মই শ্রীহরি কৃষ্ণ। তাঁকে পরমপ্রভু পুরুষোত্তমও বলা হয়। ভক্তদের কৃত সকল পূজা উপাসনা তাঁর প্রতিই সম্পন্ন হয়, তিনি যখন কৃষ্ণরূপে রাধাসহ প্রকাশিত হন তখন ‘রাধা-কৃষ্ণ’ নামে অভিহিত হন, আবার যখন নারায়ণরূপে লক্ষ্মীসহ প্রকাশিত হন তখন অভিহিত হন লক্ষ্মীনারায়ণ নামে।”
“তপস্যা ছাড়া ভগবদ্-লীলাস্বাদন করা যায় না।”
“সাধুদের পরিত্রাণের জন্য ভগবান অবতাররূপে আসেন। তিনি তো অবতরণ না করেও ভক্তদের ত্রাণের জন্য ব্যবস্থা করতে পারেন। তবুও যে আবির্ভূত হন, তার একমাত্র কারণ তিনি ভক্তদের হৃদয়ে আকাঙ্খিত রূপ ধরে মানব শরীর নিয়ে তাদের কাউকে পুত্র, কাউকে বন্ধু, কাউকে সাথী বা কাউকে আত্মীয় রূপে জাগতিক স্তরে সঙ্গ দেবেন বলে।”
“যে ভক্ত সর্বকর্মে নিজের অন্তঃকরণকে পরমাত্মায় কেন্দ্রীভূত রাখে তার সর্ব-ক্রিয়া দিব্যায়িত হয়ে যায় ।”
“প্রকৃতপক্ষে জীব ও ঈশ্বরকে ছাড়িয়ে আছেন ব্ৰহ্ম। ব্ৰহ্মই স্থান, কাল, কর্ম, মায়া, আদি সব কিছুর প্রকাশক। সবই তাঁর অধীনে। …. তিনিই সর্বকর্মের একমাত্র সংঘটক রূপে আছেন। এ জগতের সর্বময় কর্তা তিনিই। তিনিই সম্পূর্ণতঃ সমস্ত ক্রিয়ার কর্তা।”
“বিপদে পড়লে পরম শ্রদ্ধাপূর্বক ভগবানের নাম স্মরণ করো। অন্ধ বিশ্বাস, কু- সংস্কার যাদু তথা মারণ-উচাটন মেনো না।….. কপট ধর্মাচরণ করো না।”
“আধ্যাত্মিক পূর্ণতার জন্য ভগবান বা তাঁর কোনো অবতাররূপ বা বিধিবদ্ধ দেবমূর্তির ধ্যান করো।”