শ্রীমৎ হংসদেব অবধূত ভারতে এক মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ঈশ্বর উপলব্ধির জন্য ধ্যান যজ্ঞ করতেন। ইনি একজন অদ্বৈতবাদী সদ্গুরু ছিলেন। মানুষকে সত্যের পথে আহ্বান জানাতেন। অবশেষে ইনি ১৯৬০ সালে মারা যান। এনার কিছু উপদেশ নীচে উল্লেখ করা হলো।-
“সচ্চিদানন্দ পরমাত্মা সর্বদা পূর্ণ ও অখণ্ড। তাঁর মধ্যে কখনোই ভেদ সম্ভবপর নয়। পরমাত্মা ও জীবাত্মা স্বরূপতঃ একই। আত্মা অবিনাশী, অচল অর্থাৎ গতিহীন নিষ্ক্রিয়। আর এই প্রপঞ্চ জগৎ এর বিপরীত। এটি নাশবান, চঞ্চল তথা পরিবর্তনশীল, সুতরাং তা অনিত্য। এই যে আত্ম- ত্মজ্ঞান, নিত্য-অনিত্যবোধ এরই নাম বিবেক। বিবেকই সব সাধনের মূল। অন্তঃকরণে নিত্য ও অনিত্য বোধটি দৃঢ় হয়ে গেলে, স্বল্পকালীন সুখকর পার্থিব বস্তুর বিয়োগ আর জীবকে বিচলিত করতে সমর্থ হয় না।”
“জ্ঞান লাভের পাঁচটি প্রতিবন্ধক, –বিষয়াসক্তি, বুদ্ধির মন্দতা, কু-তর্ক, বিপরীত অর্থবোধ এবং দুরাগ্রহ অর্থাৎ অভিমান ‘আমিই ঠিক বুঝি, আমি সকলের থেকে বেশি বুদ্ধিমান।”
“গুণ, জাতি, সম্বন্ধ আদি যে সকল ধারণা, (বিকার) অথবা লাভ, ক্ষতি, শীত, উষ্ণাদি, কিংবা সখ-দুঃখাদি যে বোধ…..এ সবই অন্তঃকরণের ধর্ম। পরমাত্মাতে এসব কিছুই নেই। তিনি কায়ারহিত, অরূপ, নির্মল। যখন জীব এই তত্ত্বটি নিশ্চিতরূপে বোধ করে যে, আত্মা ত্রিগুণরহিত, একে কোনো বিকার স্পর্শ করতে পারে না এবং এক অখণ্ড আত্মাই সকল প্রাণীর অভ্যন্তরে বিরাজ করছেন, তখন তার কর্ম (বন্ধন) ত্যাগ হয়ে যায়, সেই ব্যক্তি পূর্ণকাম হয়। একবার আত্মার প্রকৃত জ্ঞান হলে, (তার কাছে) জগতের আর কোনো স্বতন্ত্র সত্তা থাকে না, অধিষ্ঠানরূপ আত্মায় জগতের কোনো ভিন্ন অস্তিত্ব নেই।”
“ব্রহ্ম সম্বন্ধে চিন্তা, তাঁর প্রসঙ্গে কথোপকথন, তাঁর অনন্য অস্তিত্ব এবং আত্ম স্বরূপে তাঁকে অভিন্নবোধে ধারণার প্রয়াস—এইগুলিকেই ব্রহ্মভ্যাস বলা হয়। নিস্প্রয়োজনে অনর্থক বাক্য বললে বাক্যের জোর কমে যায়। অধিক কথনে অনেক সময় বাক্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না, তাই কখনো কখনো মিথ্যা ভাষণ হয়ে যায়। ছোট ছোট কথাকে রঙ ফলিয়ে বলা, ছোট কথাকে বড় করে বানিয়ে বলা—এসব ‘বচনদোষ’। যেমন অপরের প্রশংসা করতে গিয়ে বাড়িয়ে বলা, তেমনই কারোর সামান্য দোষকে বাড়িয়ে বলাও খুব অন্যায়। কোনো কোনো লোক মনে করে যে ‘আমি যা বলি তাই ঠিক’। অপরে সত্য বললেও সেটিকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার জন্য সে খুব ব্যগ্র হয়, অথবা নিজের গুণকে অতিরঞ্জিত করে বলে এও বাক্যের বিশেষ দোষ।….. অনেকে হাসি-তামাসাপূর্বক মিথ্যা বলে থাকে, তাও ঠিক নয়।…. স্বার্থ সিদ্ধির জন্য বা নিজের দোষস্খালনের জন্য কিংবা অপরের কাছে নিজেকে উত্তম প্রতিপন্ন করার জন্য অনেকে মিথ্যা ব্যবহার করে থাকে। একবার একটা মিথ্যা বলে ফেললে, তার সমর্থনের জন্য আরও অনেকগুলো মিথ্যা বলার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। কারোর কারোর মিথ্যা বলা এমন মজ্জাগত হয়ে যায় যে, অপ্রয়োজনেও সে মিথ্যা বলে মজা পায়। …..যে মুমুক্ষু ব্যক্তি ব্ৰহ্মমার্গে গমনাভিলাষী তার এই রকম বাক্যদোষ সর্বতোভাবে পরিহার করতে হবে।”
“(বিষয় সুখে) যতই প্রবৃত্তি বাড়বে তার অপূরণে দুঃখও বাড়বে আবার যতই নিবৃত্তি (নিরাসক্ত) ভাব বাড়বে ততই চিত্ত ক্রমশঃ বাসনামুক্ত হওয়ায় তাতে সন্তোষ ও শান্তি বেড়ে যাবে। এবং ক্রমেই সকল বাসনা দূর হয়ে যাবে।”
“অন্তরে একরকম ভাব পোষণ করে মুখে অন্য রকম ভাব ব্যক্ত করা মিথ্যাচার।….যেমন বাক্যে তেমন ব্যবহারেও কোনো রকম মিথ্যাচার থাকা ঠিক নয় এবং কপটতা, প্রবঞ্চনা আদি সবই দূর করা আবশ্যক। ….সত্যে প্রতিষ্ঠিত না হতে পারলে সত্যস্বরূপকে লাভ একেবারেই অসম্ভব।”
“যখন চিত্ত থেকে সম্পূর্ণরূপে অজ্ঞানতা দূর হয়ে যায়, তখন একমাত্ৰ ব্ৰহ্মই যে সত্যবস্তু তা সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি হয়।”
“যে উপায় দ্বারা নিজের স্বরূপ আত্মজ্ঞান উপলব্ধি করা যায়, সেই পথে দৃঢ় সংকল্প ও পুরুষকারসহ চলতে হয়। তার জন্য তিনভাবে সাধনা আবশ্যক। প্রথমতঃ মনকে দৃঢ় নিশ্চয় করে অগ্রসর হতে হবে, ‘আমার দ্বারা হবে কি হবে না, পারবো কি পারবো না’, এরূপ সংশেয়কে কখনো মনে স্থান দেবে না, যা অন্যে পারে যথাযোগ্য চেষ্টা করলে তুমিও পারবে। দ্বিতীয় হলো, কখনোই আলস্য ও দীর্ঘসূত্রতাকে প্রশ্রয় দেবে না, অধ্যবসায় এবং ধৈর্য সহকারে এগোতেই হবে। তৃতীয়টি হলো, বাক্যে মৌনতা রক্ষা করতে হবে (যথাসম্ভব)।”
” প্রকৃত আত্মানন্দের বিমল সুখের আস্বাদ পেলে তখন এই জগতিক বিষয়ানন্দ যে অতি তুচ্ছ নকল সুখ, তা জীব উপলব্ধি করতে পারে।”
“সর্বজীবের প্রতি প্রীতিসহ, তাদের মঙ্গল, সুখ, নিরাপত্তা ও নীরোগ থাকার জন্য পরমসত্তার নিকট প্রার্থনা করতে হয়। এর দ্বারা…..হিংসা-বিদ্বেষ একেবারে চলে যায়। প্রার্থনা করতে হয় ‘হে প্রভু সর্বজীবের হিত হোক’ …..চাই পরমার্থ চিন্তা।”
“নিষ্ফল বাক্যের মতোই নিরর্থক চিন্তাও বর্জনীয়। অনবরত অন্যের দোষ চিন্তা করতে করতে নিজের মন কলুষিত হয়ে ওঠে।”
“সত্য, প্রিয়, হিতকর ও কোমল বাক্য সর্বদা বলার অভ্যাস আবশ্যক। ভিক্ষাপ্রার্থীকে পর্যন্ত মধুর বচনে দান কর্তব্য। কর্কশ কথা বলে দান করা ঠিক নয়, যদি দান নাও করো, মিষ্টি কথা বলতে কার্পণ্য কোরো না। দম্ভ অহংকার-এর ভাব ত্যাগ করতে হয়।”