রাজর্ষি রামমোহন রায় ১৭৭২ সালের মে মাসে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি একদিকে ছিলেন যেমন শিক্ষাবিদ তেমনি অপরদিকে ছিলেন একজন সমাজ সংস্কারক। অবশেষে ইনি ১৮৩৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইংল্যান্ডের ব্রিস্টলে শেষ জীবন ত্যাগ করেন। এনার কিছু উপদেশ নীচে উল্লেখ করা হলো।।-
“যুক্তি ও শাস্ত্র বিবেচনা না করে পূর্বকালের মানুষদের কৃত (লোকাচার ও দেশাচার) অনুষ্ঠানকে যদি কোনো মানুষ পালন করে, তার (মানসিক অবস্থানের) প্রতি পণ্ডিত (জ্ঞানী)-গণ “গড্ডালিকা প্রবাহ” শব্দের প্রয়োগ করে থাকেন। ….(এখন বিশেষ ভাবে) প্রয়োজন কুসংস্কার ও গোঁড়ামিকে আক্রমণ।”
“মিথ্যা ও প্রবঞ্চনার বেশী অধর্ম আর নেই। মিথ্যাবাদী যদি কখনো সত্যও বলে, তাহলেও কেউ তা বিশ্বাস করে না। আবার একটি মিথ্যাকে বজায় রাখতে আরও মিথ্যা দিয়ে তা সাজাতে হয়। এর বেশী প্রবঞ্চনা আর কী আছে!”
“এই জগতে বিদ্যমান প্রতিটি বস্তু পৃথক পৃথকভাবে কয়েকটি কারণ, পরম্পরা ও নিয়মের অনুবর্তী। এমনকি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সেই কারণ, পরম্পরা ও নিয়মগুলি গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, প্রতিটি পদার্থের অস্তিত্ব একটি অখণ্ড পরিকল্পনায় বাঁধা।”
“সর্ব ধর্মেরই মূল সূত্র হলো পরমাত্মা ও চিৎশক্তিতে এবং পরলোকের অস্তিত্বে বিশ্বাস। এই দুই বিশ্বাসের সঙ্গে (ধীরে ধীরে) জুড়ে গেছে শুদ্ধ-অশুদ্ধ, শুভ- অশুভ, খাদ্য-অখাদ্য ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কিত শত শত কষ্টসাধ্য ব্রত, আচার ও সংস্কার। যার ফলে মানব সমাজে কল্যাণের বদলে হয়েছে প্রচুর ক্ষতিও। সমাজজীবনে নানা বিভেদমূলক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হওয়ায় দুঃখ-কষ্ট ও বিভ্রান্তি আরও বেড়েছে। দৈবাৎ কেউ যদি অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে নিজের ধর্ম বা সম্প্রদায়ের আচার ও সংস্কার সম্পর্কে কোনো সংশয় বা মতান্তর প্রকাশ করে তবে তার ধর্ম-সম্প্রদায়ের অন্যান্যরা তাকে অত্যাচার বা ভর্ৎসনা করে। তথাকথিত অনেক ব্যাখ্যাকার আবার ন্যায় ও সততা বিসর্জন দিয়ে কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মাচারের সমর্থনে নতুন নতুন ব্যাখ্যার আমদানি করেন যা আপাতগ্রাহ্য মনে হলেও একেবারেই অবাস্তব। এবং এই ভাবেই তাঁরা সত্য-মিথ্যার বিচার বিভেদে অসমর্থ অন্তর্দৃষ্টিহীন সাধারণ নরনারীর আচার-বিশ্বাস আরো দৃঢ়ভিত্তির ওপর স্থাপিত করতে (অপ) চেষ্টা করেন।”
“যারা বুদ্ধিমান, বিবেকবান তারা জানে যে, এমন অনেক অদ্ভুত ব্যাপার আছে যা সাধারণ মানুষের বুদ্ধির অগম্য এবং আপাতভাবে যার কোনো সঙ্গত কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না, কিন্তু সূক্ষ্ম বিচারে বা অভিজ্ঞজনের কাছে শিক্ষা লাভে বহু কিছুরই সন্তোষজনক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা সত্ত্বেও কোনো কোনো রহস্য অজ্ঞাত থেকে যায়। সে ক্ষেত্রে বিবেকী বুদ্ধি (স্বজ্ঞা)-র শরণ নিতে হবে।”
“জগতে ব্রহ্ম ভিন্ন বস্তু নেই। অব্রহ্মস্তম্ব ব্রহ্মসত্তার তারতম্য নেই। শক্তিও নিত্য । ….. (ব্রহ্মস্বরূপ) ঈশ্বরের শক্তি। মায়া। ….. মায়ার কার্য দ্বারা তার অস্তিত্বের অনুমান করা যায়। যেমন অগ্নিতে হাত দিলে বোধ করা যায় তার দহনের শক্তি। ….ঈশ্বরকে অবলম্বন করে তাঁর শক্তি। মায়ার দ্বারা জগৎপ্রপঞ্চের উৎপত্তি-স্থিতি-লয় হচ্ছে।”
“কোনো বিষয়ের দুই দিক না দেখে কদাচ বিরোধ করো না। বাদী, প্রতিবাদী এই উভয়ের যথার্থ অভিপ্রায় না বুঝে একপক্ষের প্রশংসা ও অন্যপক্ষের নিন্দা করা মহতের কাছে কেবল হাস্যস্পদের লক্ষণ হয়।”
“আত্মা এক। তাঁর মায়াপ্রভাবে (বিভিন্ন দেহরূপ) প্রপঞ্চেও নানাবিধ চেতনাত্মক জীব পৃথক পৃথক রূপে আচরণ ও কর্মফলভোগ করে; পুনরায় (দেহ) প্রপঞ্চ ভঙ্গ হলে প্রতিবিম্বের ন্যায় আর ক্ষণমাত্রও পৃথকরূপে থাকে না। জীব যদিও (স্বরূপতঃ ) একক আত্মা হতে ভিন্ন নয়, তথাপি জীবের ভোগে আত্মার ভোগ হয় না।”
“মানব-প্রকৃতির মধ্যে সহজাত এমন একটি মৌলিক মননশক্তি আছে যে, যুক্তিবাদী কোনো মানুষ যদি বিভিন্ন ধর্মের মুখ্য ও গৌণ তত্ত্বগুলি নিরপেক্ষ ন্যায়-পরায়ণভাবে বিশ্লেষণ করে, তবে সে এই সকল তত্ত্বের সত্যাসত্য তথা যৌক্তিকতা ও ভ্রান্তিমূলকতা নির্ণয় করতে সমর্থ হবে। তখন সে, যেসব নিরর্থক আচার-সংস্কারমূলক বিধিনিষেধ মানুষে মানুষে বিরোধ সৃষ্টি করে এবং দৈহিক ও মানসিক কষ্টের কারণ হয়, সেগুলিকে বর্জন করে, জীবজগতের সুষম সংগঠনের উৎসস্বরূপ ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্’ সেই পরম সত্তার প্রতি শরণ নেবে এবং মানবহিতকর কর্মে সক্রিয় হবে।”
“চিরন্তন এক পরম সত্তায় বিশ্বাস, মানুষের একটি সহজাত প্রবৃত্তি।”
“এক জাতীয় লোক আছে, যারা অন্যদের সমর্থন আকর্ষণ করতে আপন ইচ্ছানুযায়ীধর্মের নাম দিয়ে মতবাদ তৈরী করে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকের মধ্যে উত্তেজনা ও বিবাদের সৃষ্টি করে। অপরদিকে আর এক ধরনের লোক আছে যারা কোনরকম বিবেচনা না করেই পূর্বোক্ত লোকেদের আনুগত্য স্বীকার করে। তৃতীয় আর এক দল লোক আছে যারা অন্যদেরও নিজেদের দলে (জোর করে) টানতে চায়। চতুর্থ শ্রেণীতে আছেন তাঁরা যাঁরা মহামহিম ঈশ্বরের করুণায় প্রতারক নন, প্রতারিতও নন। ….সংস্কারমুক্ত ও ন্যায়সঙ্গত দৃষ্টিভঙ্গীসহ বিচার করে চলাই শ্রেষ্ঠ জীবনাদর্শ। ঈশ্বর মানুষকে যে বোধ (মনন) শক্তি প্রদান করেছেন, তার অভিপ্রায় হলো এই যে, স্বজাতীয় অন্যান্য অধিকাংশ মানুষের মতো সে পশুবৎ অনুকরণ না করে নিজের অর্জিত জ্ঞানের সহায়তায় প্রত্যেক ব্যাপারে শুভ-অশুভ বিবেচনায় নিজের বোধশক্তিকে প্রয়োগ করবে। (বস্তুতঃ) তখনই এই ঈশ্বরদত্ত (ক্ষমতা) বোধশক্তি সার্থকতা লাভ করবে।”
“প্রপঞ্চ মায়ার কার্য—জড়রূপ। পরমাত্মা চিদাত্মক। তিনি ওই জড়রূপ নানা প্রপঞ্চে প্রতিবিম্বিত হয়েছেন। যেমন নানা পাত্রস্থিত জলে এক সূর্যের অনেক প্রতিবিম্ব দেখা যায়, সেই সেই প্রতিবিম্ব জলের কম্পনে কম্পিত মনে হয়, কিন্তু সেই জলকম্পনে সূর্য কম্পিত হন না, সেই প্রকার জীবের হিতাহিত ভোগ পরমেশ্বরে স্পর্শ করে না।”
“কোনো তথ্যের সত্যাসত্য, সেই তথ্যে বিশ্বাসীদের সংখ্যাধিক্যের ওপর নির্ভর করে না, কারণ সত্যানুসন্ধিৎসু সবাই স্বীকার করেন যে সংখ্যা গরিষ্ঠের বিরোধিতা থাকলেও সত্যানুসরণ অবশ্য কর্তব্য।”
“সমষ্টি চৈতন্যস্বরূপ পরমেশ্বরকে অবলম্বনে চৈতন্যরূপী জীব, প্রতিবিম্বরূপে পৃথক পৃথক উপলব্ধি হয়ে পুনরায় আত্মাতে লয় পায়। উপাধি ত্যাগ হলে পৃথক পৃথক জীব পরমেশ্বরে লীন হয়ে যায়।”