শ্রীমৎ রমণ মহর্ষি ৪৫টি ভাবনামূলক বাণী

শ্রীমৎ রমণ মহর্ষি ১৮৭৯ সালের ডিসেম্বর মাসে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের তামিলনাড়ুতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। একদিকে তিনি যেমন ছিলেন ঋষি তেমনি অপরদিকে ছিলেন তিনি দার্শনিক। অবশেষে ইনি ১৯৫০ সালের এপ্রিল মাসে জীবন ত্যাগ করেন। ইনার কিছু বিশিষ্ট বাণী নিচে উল্লেখ করা হল।-

Image by pixabay.com

“আত্মদর্শন মানে কি? -এটি তো একটি কথামাত্র। অনেকে ভাবে যে এটি যেন একটা অলৌকিক ব্যাপার। উর্ধ্বস্তর থেকে কোন স্বর্গীয় জ্যোতির রশ্মি নেমে আসবে সাধকের সামনে ! তা তো নয়। প্রকৃতপক্ষে দেহাত্মবোধ কিংবা উপাধিগত ভাববে ‘আমি এই’ ‘আমি ওই’ ইফতারি সব ভ্রান্তবোধ সমূলে দূর হয়ে যাবে, তার ফলে তুমি স্বরূপতঃ যাছিলে ও চৈতন্য বোধের প্রকাশে ‘আত্ম’ -সচেতন হয়ে যাবে। অর্থাৎ অজ্ঞানতার আবরণ দূর হয়ে শুদ্ধ অমর আত্মবোধে জাগৃতিই আত্মদর্শন।”

“নিজের বোধে আপেক্ষিক দশাকে অতিক্রম করো। একটি স্বতন্ত্র সত্তা যখন অন্য কিছুকে চেনে, সেটিকে সে নিজের থেকে আলাদা রূপেই দেখে। যা দেখে সে অহং- ‘দ্রষ্টা’ আর যা দেখে তা ‘দৃশ্য’। এ দুটির যে একক আধার সেটিই ‘আমি’- এর মধ্যে ‘চিৎ’ রূপে অবস্থিত । ‘দৃশ্য’র ছবি পরিবর্তনের কারণে পরপর পাল্টে যায়, হারিয়ে যায়। কিন্তু স্রষ্টার স্বরূপ (চিৎ) সর্বদা একইভাবে থাকে, কিন্তু দৃশ্য পাল্টে যাওয়ায় স্রষ্টার স্বতন্ত্রবোধক ‘অহং’ দশাও পাল্টে যায়, ফলে সেই পরিবর্তনশীল ‘অহং’ও বস্তুতঃ ‘দৃশ্যে’র মধ্যেই পড়ে। সুতরাং ওই ‘দৃশ্য’, যার মধ্যে স্রষ্টার ‘অহং’ও একটা অংশ, সেই সবেরই অতীতে অর্থাৎ জগদতীতে ভাবে বিদ্যমান আছে ‘আত্মা’ – চৈতন্যস্বরূপ।

“আত্মবিশ্লেষণের বিচার প্রক্রিয়াটি একটি মানসিক উত্তম মাত্র নয়। এর আসল উদ্দেশ্য হলো সামগ্রিকভাবে ‘মননশক্তি’কে নিজের ‘অহং’ বুধের উৎসে ফিরিয়ে নেওয়া। প্রকৃতপক্ষে অনুসন্ধানের প্রবণতাকে ঘুরিয়ে অন্তর্মুখী করার চেষ্টা প্রয়োজন। সেই মুহূর্তে ‘অহং’ বোধের উৎসে মনন শক্তি পৌঁছায় অহংবোধক অজ্ঞনতা উবে যায় এবং বিশুদ্ধ আত্মবোধ প্রকাশিত হয়। এই বোধ সমস্ত দ্বৈতবোধ তথা দ্বন্দ্বের অতীত বোধ, কালাতীত, গুনাতীত বোধ – যা সর্বদাই বিদ্যমান থাকলেও অহং -বিচ্ছিন্নতা বোধের কারনে জীবনবোধে বিশুদ্ধভাবে অনুভূত হতে পারে না।”

“একমাত্র বিনয়-নম্রতাই অহংকারকে বশীভূত করতে পারে। ওই ‘অহংকার’ই জীবনবোধকে ঈশ্বরের থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। ঈশ্বরের পথে দরজা সর্বদাই উন্মুক্ত থাকলেও তার উচ্চতাটা বেশি নয়। ফলে প্রবেশ করতে হলে মাথা নিচু করে ঢুকতে হয়। যদি অন্তঃকরণের সামান্যতম অহমিকা থাকে, তাহলে সেটিং দ্রুত বেড়ে ওঠে আধ্যাত্মিক উন্নতিকে নষ্ট করে দেবে।”

“আমাদের যেন দুটো ‘আমি’ আছে। একটি নকল ‘আমি’ এবং অহং অপরটি ‘আমি’ বা আত্মা। জীবনবধে নকলটিকে আসল বলে ধরাটা এত দৃঢ় হয়ে যায় যে, এই নকল মুখোশটি ছাড়া স্বয়ং নিজেকেই মানুষ অন্য কিছু ভাবতে পারে না। এই মুখোশটিও এক একটি উপাধি ধরে রং পাল্টায়। আমাদের যা কিছু অভিজ্ঞতা ঘটে সবই গড়ে ওঠে অহংবোধকে ঘিরে। নিদ্রা থেকে জাগ্রত হওয়া মাত্র সর্বদা এই অহংবোধকে আশ্রয় করেই আমাদের জগৎবোধটি প্রকাশিত হয়। কোনক্রমে একবার যদি কারোর মনে আত্মবিশ্লেষণ শুরু হয়, দেখা যাবে এই নকল ‘আমি’ কে ধরে গড়ে ওঠা জগৎবোধ ভেঙে পড়বে। শুধু প্রয়োজন বস্তুকেন্দ্রিক ব্যবহারিক বুদ্ধির চেয়েও শক্তিশালী বুদ্ধিতে তীক্ষ্ণ যুক্তি প্রয়োগে অন্তর্মুখী অন্বেষণ। অবশ্য এই বুদ্ধিও তলিয়ে যাবে সত্য প্রকাশে। কিন্তু যতক্ষণ না জাগ্রতি ঘটবে বিচার অপরিহার্য।”

“কোন কর্মই আধ্যাত্মিক পথে বাধা সৃষ্টি করে না, বাধা হল শুধু ‘অহং-কর্তা’ বোধটুকু। যদি আত্মবিশ্লেষণ বিচারের দ্বারা অহংটিকে চিনতে পারো তাহলেই ওই বাধা দূর হয়ে যাবে। অহং কর্তৃত্ববোধক ভ্রান্তটি দূর হলেই স্বাভাবিকভাবেই নিরাশক্ত বোধে সর্বকর্ম ঘটবে। তাতে কাজও উন্নততর হবে, অথচ অন্তঃকরণে জাগ্রত থাকবে সহজ, শান্ত, আনন্দময় নিত্য আত্মবোধ।”

“একজন আত্মজ্ঞানীও স্বাভাবিক দৈহিক ক্রিয়াদি করতে পারেন অন্যদের মতোই। এটা ঠিকই যে প্রয়াস বা সংকল্প ছাড়া কোন কর্ম করা যায় না। সুতরাং সকল কর্মীরই কাজের পেছনে কোন না কোন সংকল্প থাকেই। সংকল্প দু’রকম হয়। প্রথমটি হল ‘বদ্ধহেতু’ যা বদ্ধ করে, আর দ্বিতীয়টি ‘মুক্তহেতু’ যা বদ্ধ করে না। প্রথমটি ত্যাজ্য, কিন্তু দ্বিতীয়টি তা নয়। বস্তুত পূর্ব সংকল্প ছাড়া কোন কর্মও হয় না। কিন্তু জ্ঞানের কর্ম প্রারব্ধগত অর্থাৎ নতুন কর্ম নয়। প্রারব্ধগত কর্ম ভোগ কারোরই নতুন কর্মফল যুক্ত হতে পারে না। বস্তুত ‘আমি কর্তা’ বোধে আত তানুসন্ধানের প্রয়াসরূপ কর্ম দ্বারাই ফলরূপ মুক্তি ঘটে”

“সমস্ত সুখ-দুঃখ অহংস্বাতন্ত্ররূপ মিরচীকাবৎ প্রকাশের মিথ্যা জল তরঙ্গের মত। অহংকারের ভিত্তি একমাত্র আত্মাই সত্য।

Image by pixabay.com

“প্রকৃত আত্মবোধে জাগ্রত হওয়ায় সমাধি অবস্থা। আত্মজ্ঞানীর পক্ষে এই সমাধির কখনো ভঙ্গ হয় না। কারণ তিনি সর্বদাই সত্য স্বরূপ আত্মবোধে সচেতন থাকেন। তাই তিনি যাই করুন সবই ঘটে প্রারব্ধগত কর্মস্পন্দনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। জ্ঞানী দেহগত প্রকাশে অন্যদের থেকে আলাদা প্রতিমান হলেও স্বরূপতঃ কোন কিছুকেই নিজের থেকে ভিন্ন দেখেন না। তার কোন কাজেই বিধি-নিষেধ নেই। তার আধারে দেহাদি মাধ্যমে পরিবেশাশ্রয়ে যেমনটি হওয়ার হয়ে যায়। কাজের জন্য তার কোন ফল ভোগও করতে হয় না। কারণ তার তো ‘আমি কর্তা’ বোধই থাকে না। তিনি হয়ে যান অখণ্ডেশ্বরেরই একটি চলমান সিমায়িত দিব্য প্রকাশ।”

“কেবল নির্বিকল্প সমাধিতে জীববোধ বা মন আত্মার আত্মজীতে লয় হয়ে যায়, কিন্তু বাসনা মুক্তি ঘটে না। ফলে জিবমুক্তি হয় না। একমাত্র ‘অহং-স্বাতন্ত্রবোধ’ দূর হলেই ‘জীববোধে’র বা জীবচিত্তের মুক্তি ঘটে। বস্তুত ‘কেবল নির্বিকল্প’ সাময়িক প্রকাশ। ‘সহজ নির্বিকল্প’ স্থায়ী বোধ। ‘সহজ সমাধিতে’ জিবোর্ড বা মন শুদ্ধ আত্মবোধে মিলিত হয়ে যায়।

সুতরাং পূর্বের অহং কেন্দ্রিকভাবে বিচ্ছিন্নতাবোধের আশ্রয়ে গঠিত পার্থক্যবোধগুলি আর প্রতিবন্ধকতা করে না। এরূপ ব্যক্তির কাজকর্ম অনেকটা ঘুমন্ত অবস্থায় গাড়িতে ভ্রমণরত যাত্রীর মতো। অর্থাৎ তার আর কর্তৃত্ববোধ থাকে না, কিন্তু দেহ-প্রাণ-মন-বুদ্ধি-বিবেক হৃদয় ধরে পরিবেশে যা হওয়ার হয়ে যায়। এ-ই হল সহজ সমাধিতে জ্ঞানীর অবস্থা। তিনি ‘অহং-স্বাতন্ত্রবোধ’ হীন চেতনায়, উদ্যোগহীন, প্রয়াসহীন, চাহিদাহীন, চেত নাই মুক্তবোধে বিচরণ করেন।

আত্মজ্ঞানীরও দেহবোধ থাকে, কিন্তু অহংবদ্ধ অজ্ঞানীদের থেকে তাতে কিছু তফাৎ থাকে। অজ্ঞানি মনে করে দেহটাই ‘আমি’ আর জ্ঞানী জানেন যে সবই আত্মময় বা ব্রহ্মময়। শরীরে যদি যন্ত্রণা হয় তবে, সেটাও অস্তিত্বের অংশ। আত্মা হল পূর্ণ অস্তিত্ব। আসলে প্রারব্ধের কারণেই দেহগত ব্যাপারগুলি থাকে, এমনকি ভোগ বাসনাও থাকতে পারে প্রারব্ধের কারণে । যাই থাক, তাতে জ্ঞানের কোন কর্তা’ বোধ থাকে না।”

“প্রতি জীবের সর্ব চিন্তা তথা বোধের আদি ও প্রথম হলো ‘আমি’ বোধ বা চিন্তা। এটির উপর ভিত্তি করেই বাকি সব চিন্তা জাগে। ‘আমি’ বোধ ধরেই ‘তুমি’ বোধ তথা সব বোধ জাগে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে সর্বাগ্রে যেমন ‘আমি’ বোধক চিন্তাটি জাগে এই ‘আমি’ চিন্তাটাই যায়ও সবার শেষে। এই জীবগত ‘আমি’র অন্তরালেই রয়েছেন সর্বধার ‘আমি’ বা আত্মা। ইনি পরমাত্মা। একজন ব্যক্তি তখনই আত্মজ্ঞানী হয়ে ওঠে যখন তার ‘স্বতন্ত্র-আমি’ বোধ এই ব্যপ্তিস্বরূপ পরমাত্মায় অভিন্ন বোধে উত্তরণ লাভ করে।”

“কেউ যদি লক্ষ্য করে, তার মধ্যে কোন উৎস থেকে ‘আমি-আমি’ বোধ হোক স্পন্দনটি জাগছে, তার মন তাহলে সেখানে গুটিয়ে যেতে থাকবে -এটাই তপস্যা।… একইভাবে মন্ত্র জপ করার কালে কেউ যদি সেই শব্দের উৎসটির দিকে নজর দেয়, সেখানে তার মন গুটিয়ে যেতে থাকবে। -ওই হল তপস্যা।”

“কল্পনায় নির্মিত এই জগৎরূপ স্বাপ্নিকলীলার সচেতন নির্মাতা হলেন ঈশ্বর, চিনি স্বরূপতঃ পরমাত্মা। এই জগতের কোন জীবেরই এই অদ্বিতীয় আত্মার থেকে স্বতন্ত্র কোন আত্মা-অস্তিত্ব নেই। কিন্তু ঈশ্বরের মতো জীবও এই স্বপ্ন নির্মাতা না হলেও, যেহেতু প্রতিটি জীবী সেই ঈশ্বরের সঙ্গে আত্মস্বরূপে অভিন্ন , সুতরাং প্রতিটি জীব যা দেখছে তাও স্বপ্নবৎ।”

“প্রথমে নিজের সত্যস্বরূপকে জানো, তারপরই তুমি সেই অবস্থা লাভ করবে, যেখান থেকে এই জগৎ প্রবাহের অন্তরালে বিরাজমান সত্যটিকে জানতে পারবে। জীবরূপে যে জগতের একটি অংশ তুমিও।”

Image by pixabay.com

“বুদ্ধি দ্বারা, তারও অতীতে বিদ্যমান ‘আত্মা’কে কখনো জানা যেতে পারে না। কিন্তু শুধুমাত্র বুদ্ধির দ্বারা যে আত্মবোধের জাগ্রত হওয়া যায় না, সেই বুদ্ধিগত সীমানাটা অবশ্যই উপলব্ধি করা যায়।

“তুমি যদি নিজের প্রকৃত আত্মস্বরূপটি উপলব্ধি করো এবং জানো যে, কোন কর্মেই তুমি কর্তা নাও। তাহলে ভাগ্য, প্রারগ্ধ এবং ঐশী পরিকল্পনায় তোমার মাধ্যমে যে কর্মই ঘটুক তুমি কোনক্রমেই সেই কর্মফলে জড়িত হবে না। আসলে তুমি তো সর্বদাই মুক্তচৈতন্য। এবং সেই মুক্তবোধের কোন সীমা নেই।”

“অবিরাম অহং বোধের উৎস ‘আমি’র অনুসন্ধান করো।… বিশুদ্ধ আমি ‘সৎ-চিৎ-আনন্দ’ ব্রহ্মা।- যখন এই বোধটিতে দৃঢ়ভাবে থেকে যায় তখন আর কোন ব্যাপারই এমনকি বেদনাও বিচলিত করতে পারে না।”

” ‘স্বাধীন ইচ্ছা’ আর ‘ভাগ্য’ নিয়ে চিন্তায় দ্বন্দ্ব ততক্ষণই থাকে, যতক্ষণ না এই দুইয়ের উৎসটিকে চেনা যায়। সেটি জানলে আর এই দ্বন্দ্ব থাকে না। বস্তুত সর্ব ক্রিয়ারই উৎস একক ব্রহ্মশক্তি।”

“নির্ভীকল্প বোধ আশ্রয়ে সমাধির প্রকাশ দুই ভাবে হতে পারে। প্রথমটিতে, জীব মন বা বোধ সম্পূর্ণভাবে মিলে যায় আত্মবোধক উৎসে, তাই সেই অখণ্ড অদৈত্যবোধে আর কোন বোধ থাকতেই পারে না। দ্বিতীয়টিতে, জীববোধ যদিও শুদ্ধ আত্মবোধে মিলিত থাকে, কিন্তু জগৎবোধটিও থাকে, যদিও তা কোন ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া ঘটায় না; একটি শান্ত সমাহিত নিস্তরঙ্গ সাগরের মত বোধশ্রয়ে সেটি থাকে। দু’রকম সমাধিতেই স্বরূপানন্দ অনুভূতি থাকে, যখন এই দুই বিভাবের সমাধিতেই স্বরূপানন্দ অনুভূতি থাকে, যখন এই দুই বিভাবের সমাধিকে একেরই প্রকাশ বলে বোঝা যায়, তখন উপলব্ধ হয় ‘সহজ নিরিকল্প সমাধি’।”

“পরমআত্মা অসীম অস্তিত্ব। তার আত্মশক্তিই ‘ঈশ্বর -মন’ রূপে বিকশিত -এই মহা মনের সক্রিয়তাতেই জীবজগতের প্রকাশ। প্রকৃতপক্ষে সবই সেই আত্মার মধ্যেই প্রকাশিত। তার বাইরে কোন কিছুই নেই।”

“ব্রহ্মা বা মূল উৎস হল একটি ব্যাপ্তৃহীন বিন্দু। এটি একধারে মহাশূন্যরূপে অপরদিকে আনন্দময় সত্তা রূপে প্রসারিত। সেই উৎসটি হল কেন্দ্র যা থেকে ইচ্ছা প্রবাহিত হচ্ছে, এবং ভোক্তা ‘অহং’ ভোগ ‘আস্বাদন’ ও ভাগ্য ‘জগৎ’ রূপ বিকাশ হচ্ছে।”

“জীবের প্রারব্ধানুসারে বিধাতা তাকে পরিচালিত করেন। যা না হওয়ার তা হতেই পারে না। যে যতই চেষ্টা করুক, আবার যা হওয়ার তা হবেই হবে, যে যতই বিরোধিতা করুক না কেন। এটি নিশ্চিত, সুতরাং নির্বিকার থাকাই ঠিক পন্থা। পূর্বক্ত চেষ্টা ও বিরোধিতাও যেমনটি হওয়ার হবে।”

” ‘এক আত্মা সবকিছুর মধ্যে আছেন’ বলা মানে যেন, একটি দর্পণই সমস্ত প্রতিবিম্বের মধ্যে আছে। কিন্তু তাতো নয়, দর্পণের মধ্যেই প্রতিবিম্ব থাকে। এমনই যা কিছু আছে সবই এক সত্যস্বরূপ অদ্বিতীয় আত্মার মধ্যেই প্রকাশমান ও বিদ্যমান।”

“তুমি নিজেকে দেহের সীমানায় ভাবলেই, আর সবকিছুকে তোমার বাইরে বলে ভাববে। কিন্তু তুমি তো আসলে ওই দেহটা নও। তুমি চৈতন্য স্বরূপ আত্মা।… সেই ব্যপ্তিস্বরূপ অদ্বিতীয় আত্মার মাঝে সমস্ত জীবদেহগুলি ঘুরে বেড়াচ্ছে। আত্মা অচল অচল অপরিবর্তনীয় এক দশায় নৃত্য বিদ্যমান অস্তিত্ব।”

“নিদ্রা ভঙ্গের ঠিক পর মুহূর্তেই যে ‘আমি’ বৌদি জাগে, সেটি শুদ্ধ ‘আমি’ কিন্তু জীবব্ধে পরক্ষণেই পরিবেশ ও সংস্কার ধরে অন্যান্য ভাব গুলি দ্রুত গতিতে এসে পড়ায় এই শুদ্ধবোধটি আর প্রকাশিত থাকে না, আবৃত হয়ে যায়।”

“একটি প্রস্তর খণ্ডকেও যদি গভীর ভক্তিসহকারে পুজো করা হয়, সেটি পর্যন্ত ঐশ্বরিক প্রকাশ হয়ে উঠতে পারে – ভক্তি হল জ্ঞানমাতা।”

“আত্মানুসন্ধান করে ‘অহং’ গ্রস্ত জীববোধই। প্রকৃত আত্মাসত্তার দ্বারা বিচার-বিশ্লেষণ করার প্রশ্নই ওঠে না। শুদ্ধ আত্মচৈতন্য তো সর্বদা একই অবস্থায় বিরাজমান। বস্তুতঃ যে ‘আমি’কে নিয়ে বিচার করা হয় সেটি ‘অহং’ -আমিই। তারপর বিচার করতে করতে সেই অহং এর বিলোয়ে প্রকাশিত হয় প্রকৃত আত্মবোধ।”

“আমরা প্রত্যেকেই শান্তস্বরূপ সত্তা। কিন্তু অজ্ঞানতার কারণে আমরা বাইরে শান্তি খুঁজি -যে মুহূর্তে কোন মানুষ তার মনশক্তিকে বহিঃমুখী সব বস্তু থেকে সরিয়ে অন্তর্মুখী করবে এবং আত্মস্থিত হবে, সে উপলব্ধি করবে দ্বন্দ্বাতীত , গুণতীত চিরমৌন স্বরূপকে , এবং সে লাভ করবে নিত্য শান্তি ও প্রসন্নতা।”

“জাগ্রত দশাতেই সুষুপ্তির দশার মত আত্মবোধে সচেতন হলে আত্মজ্ঞানে জাগ্রত হবে।”

“আত্মানুসন্ধানের সাধনাকে লক্ষ্যে পৌঁছানো অবধি একাগ্রভাবে পরিচালিত করতে হয়। মধ্যবর্তী কালে যে দশা, যে ক্ষমতা, দর্শন বা বিশেষ অনুভূতিই লাভ হোক না কেন, যতক্ষণ না অদ্বিতীয় আত্মবোধের উপলব্ধি ঘটছে ততক্ষণ সর্বদাই অনুসন্ধিৎসু থাকতে হবে ওই সকল অভিজ্ঞতা কার হচ্ছে তাকে চেনার জন্যই, ওই বিষয়গুলিতে নয়।”

“অহং কর্তিত্তবোধের মিথ্যাত্ব সবাইকে বোঝানো যথার্থ নয়। তামসিক ও রাজশিক চেতনার অযোগ্যবোধের লোককে বললে শুধু অযথা তর্কাতর্কিই হবে।”

“যা জন্মায়, তা মরে; যা পাওয়া যায়, তা হারাতেও হতে পারে। তুমি কি জন্মেছো? না, তুমি সবসময়েই বর্তমান; আত্মা কখনো হারায় না।”

“জীবগত অহংবোধই পূর্ব জন্মার্জিত সংস্কারসমূহের বীজধারন করে থাকে।”

“এক অদ্বিতীয় সত্তা সমগ্র জগৎ পরিচালনা করেছেন। এবং জগতের সব কিছুকে দেখা তারই ক্রিয়াগত ব্যাপার। যিনি জগতে জীবন সৃষ্টি করেছেন, তিনি জানেন এটিকে কিভাবে দেখতে হবে। তিনি জীবজগতের সম্পূর্ণ ভার বহন করেন।”

“একজন ব্যক্তি তার সাধনায় বহুদূর অগ্রসর হলেও, যতক্ষণ না সে নিজের প্রশংসা শুনতে ভালো লাগার আগ্রহ অতিক্রম করতে পারবে, সে সাধন লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে না।”

“এক জীবনীশক্তিই বিভিন্ন ইন্দ্রিয় শক্তিতথা চেতনাশক্তি বা মনরুপে প্রকাশ পায়। প্রকৃতপক্ষে মনঃশক্তি আত্মারই একটি শক্তিরূপ প্রকাশ।

Image by pixabay.com

“দৈহিক কৃচ্ছ্রসাধন করো না।… কিন্তু দেহের দিকে প্রয়োজন মেটানোর জন্য অতিরিক্ত নজরও দিও না।”

“স্বপ্নভঙ্গের পর জীব বোঝে যে স্বপ্নে সে যা কিছু দেখছে সবই তার নিজেরই বিভিন্ন রূপ। সেই রকম জ্ঞানী জানেন যে, জীবজগতের সবই এক সত্তার কল্পনাজাত বিভিন্ন রূপ।”

“যখন কোন জিবোধের অজ্ঞান-আবরণ ভেঙে শুদ্ধ আত্মবোধটি প্রকাশিত হয়, সেই প্রথম অবস্থায় থেকেই এই দিব্য মহাশক্তি তাকে অধিকার করে, – এই শক্তি সমস্ত জীবমনের অন্তরালে পরিচালিকা শক্তি অর্থাৎ ব্রহ্মশক্তিরই প্রকাশ।”

“ব্রহ্মচর্য হল ব্রহ্মে অবস্থান করা; এর সঙ্গে ইন্দ্রীয়সংযমের কোন প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই।

“জগতে ভালো-মন্দ যেমন ঘটনায় ঘটুক না কেন নিজের বোধে বুঝতে হবে যে সমগ্র জগত-জুড়ে অনন্ত লীলা প্রবাহ চলছে, -এই দশাটা তারই মধ্যের অবিচ্ছেদ একাংশমাত্র।”

“আসক্ত হয়ে কর্ম করায় বন্ধন।। কিন্তু অনাসক্ত কর্ম কর্মীকে স্পর্শ করে না”

“পরমাত্মার এক অদ্ভুত শক্তি এই মনঃশক্তি, অনির্বচনীয় এর ক্ষমতা, -ঈশ্বর, জীব ও জগতের প্রকাশ এই মনোশক্তি সাপেক্ষেই ঘটে।

Leave a Reply