পান্নালাল দাসগুপ্ত ১৯০৮ সালে অভিভক্ত বাংলাদেশের শরীয়তপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি একদিকে যেমন সাংবাদিক ও সমাজসেবী ছিলেন একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। অবশেষে তিনি ১৯৯৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন। ইনার কিছু বাণী নিচে উল্লেখ করা হলো।-
“মৌলবাদ আছে। অথচ মৌলবাদের গোড়াকার কথা যে মূল্যবোধ সেদিকটার দিকে কোন লক্ষ্য নেই। মূল্যবোধহীন যেকোনো ধর্ম, তা হিন্দু ধর্মই হোক, মুসলমান কিংবা খ্রিস্টান ধর্মই হোক -মূল্যবোধহীন মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতাবাদে পরিণত হতে বাধ্য। বস্তুত আমাদের রাজা রামমোহন রায়, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ -এরা কি ফান্ডামেন্টালিস্ট ছিলেন না। তারা তো সকলেই বেদ, উপনিষদ, গীতা ইত্যাদিকে ভিত্তি করে তাদের সমগ্র জীবন দর্শন দাঁড় করিয়েছিলেন। কিন্তু ফান্ডামেন্টালিজম বা মৌলবাদ তাদের সাম্প্রদায়িক করেনি। তাদের তো আন্তর্জাতিক মানবতাবাদেরওপরই বিশ্বাস ছিল।”
“পৃথিবীর মহামানবেরা কেউ জাতীয়তাবাদী ছিলেন না। না বুদ্ধ না যীশু, না রামকৃষ্ণ বা বিবেকানন্দ। সকল দেশের মানুষের কাছেই ছিল তাদের চৈতন্যর প্রতি আবেদন।”
“আজ গ্রামে সেই স্বাবলম্বী অর্থনীতি এবং স্বশাসিত স্বরাজ ব্যবস্থা করতে হলে সম্ভাব্য সকল প্রকার আক্রমণের বিরুদ্ধে গ্রামগুলিকে সংগ্রাম করতে হবে। পাকিস্তান ও চীন আমাদের আক্রমণ নাও করতে পারে। কিন্তু যার আক্রমণে গ্রামগুলি তাদের স্বরাজ হারিয়ে ফেলেছে, আত্মনির্ভরতা, স্বনির্ভরতা, স্বাবলম্বন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তা হচ্ছে বহুজাগতিক শিল্প বাণিজ্যের অগ্রাসী সভ্যতার বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা। এবং ভারতের বাইরে থেকে কোন যুদ্ধ আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার পথ একটাই – তা হল স্বাবলম্বন ও স্বরাজের পথ। তা যদি করতে হয় তাহলে গ্রামের পুনরুজ্জীবনের আন্দোলন করতে হবে।
“মানুষত্ববোধ মূল্যবোধের উপরই প্রতিষ্ঠিত। সমস্ত আদর্শবান বা মতাদর্শের বিল্ডিং ব্লকগুলি এই মূল্যবোধ দিয়ে গঠিত ও প্রসারিত। মূল্যবোধের রাশির এক কুৎসিত উপসর্গ আজ দেখা দিয়েছে সমাজ, শিক্ষা, রাজনীতি তথাকথিত ধর্ম গুলির মধ্যে। তার কারণ মূল্যবোধের উপাচার বা বিল্ডিং ব্লক গুলির অভাব। ভিত্তিহীন নানা ধর্ম ও মতাদর্শের কারণ এইটাই – মূল্যবোধের অভাবটাই । অথচ মূল্যবোধ পৃথিবী থেকে উধাও হয়ে যায়নি, যতদিন মানুষ থাকবে এবং মানুষের মানসিকতাবোধের প্রয়োজন উপলব্ধ হবে ততদিন প্রতিদিনের জীবনে, পরিবারে, সমাজে, হাটে-বাজারে, অফিস-আদালতে তার মূল্যবোধের প্রশিক্ষণের সাধনা থাকতেই হবে। আর যদি এই মূল্যবোধটাকে বাঁচাতে পারি তবে মতাদর্শের বা এডিওলজির উত্থান পতনে কোন ভয় পাবার কারণ নেই। মতাদর্শের বা ইডিওলজির ইতিহাস বড় জোর দুইশো থেকে আড়াইশো বছরের। কিন্তু মানুষের জীবন ও সমাজ লক্ষ লক্ষ বৎসরের, এবং তা ইডিওর জিনির্ভর নয়, মূল্যবোধ নির্ভর। কাজেই মানুষের ভয় নেই, মানুষ অমৃতের সন্তান।”
“আমাদের জীবনে, প্রাত্যহিক জীবনে সাম্যবাদের বীজ গুপ্ত আছে। প্রত্যেক পরিবারের মধ্যে ছোট-বড় প্রায় সব পরিবারের মধ্যেই এই সাম্যবাদী প্রেম ও দায়-দায়িত্ব আছে। সাম্যবাদ প্রশিক্ষণ আমরা প্রত্যেকেই জন্মাবোধি পরিবার গুলির মধ্যেই পাই, যেখানে সুখ-দুঃখ সমানভাবে ভাগ করে নেবার শিক্ষা-দীক্ষা আছে।”
“বুদ্ধিজীবীদের বিশ্লেষণ যত বাড়ছে আমাদের খন্ড চিন্তা ততই আরও দ্বিখণ্ডিত হচ্ছে। সারা পৃথিবীতেই বুদ্ধিজীবীদের অসফল্য অত্যন্ত স্পষ্ট।”
“চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহা ও ত্বক এই ইন্দ্রিয় গুলির নিজেদের কোন বিচার শক্তি ও ভোগ শক্তি থাকে না। এই ইন্দ্রিয় গুলির পেছনে আছে ‘মন’। মনকে তাই তারা সকল সংযমের বাঁধন থেকে মুক্তি করে দিল। মনের মধ্যেই আছে নানা বাসনা, কামনা, অতৃপ্তির ক্ষুধা, সে অল্পে সন্তুষ্ট নয়।”
“পরিবার নামক সংগঠনটি, অর্থাৎ যে পরিবারে আমার জন্ম হয়েছে সেটা একটা নৈসর্গিক সংগঠন, আপনা থেকে পাওয়া সংগঠন।”
“সাংস্কৃতিক ব্যাপারটা সম্বন্ধেও একটু সাবধান হতে হবে। কেননা কালচারাল কনকুয়েস্ট বলে একটা কথা আছে। এই কালচারাল কনকুয়েস্ট কথাটাও কম উপদ্রবকারি নয়। এখন ইংরেজরা আমাদের এই উপমহাদেশ থেকে চলে গেছে বটে কিন্তু তাদের কালচারাল কনকুয়েস্ট এখনো এই উপমহাদেশের ওপর বেশি করে গেড়ে বসেছে। ভোগবাদী সভ্যতারও একটা কালচারাল কনকুয়েস্ট সম্পর্কে একটু সাবধান হওয়া দরকার । তাছাড়া এই কালচারের মধ্যে ফান্ডামেন্টালাইজমকে একটা কালচার বলতে হবে যেমন ইসলামিক ফান্ডামেন্টালিজম, মার্কসীয় ফান্ডামেন্টালিজন। অতএব ফান্ডামেন্টালিজমের দৌরাত্মক সম্পর্কেও আমাদের একটু সাবধান হতে হবে। কেউ কারো ঘারে কিছু চাপিয়ে দেবার প্রচেষ্টা না করাই ভালো।
“গুরু নানক, আসামের সংকরদেব, চৈতন্য মহাপ্রভু সকলেই পদযাত্রা করেছেন। কিন্তু তাদের পদযাত্রা ও বর্তমান ভারতে ‘ভারত জোড়ার’ জন্য যে আধুনিক পদযাত্রীদের দেখছি, এদের মধ্যে মিল বিশেষ কিছু নেই। রাজনৈতিক বা ভৌগোলিক লক্ষ্যের সীমানা এসব নব পদযাত্রীদের দৃষ্টিভঙ্গিকে অতিক্রম করতে পারেনি। সেদিনকার পদযাত্রিক চৈতন্য, শংকর দেব, নানক, শংকরাচার্য, দীপঙ্করেরা কোন যান্ত্রিক যানবাহনের সাহায্য, কোন খবরের কাগজ, রেলগাড়ি বা বা হাওয়াই জাহাজের সাহায্য নেয়নি। অথচ তাদের বাণী কিরকম অমোঘ অব্যর্থ ছিল। প্রাণের গভীরে বাণী প্রবেশ করতো, মানুষের প্রাণে এক ঝংকার সৃষ্টি করতো। কাজেই মনে হয় যোগাযোগ ব্যবস্থার আধুনিক উন্নতি বা যান্ত্রিক সাহায্য প্রকৃতপক্ষে এ জাতীয় ভারত জোড়বার প্রকৃত গাঁথুনি দ্রব্য বা সিমেন্টিং দ্রব্য নয়। এর জন্য চাই ভিন্ন ধরনের এক মিডিয়া, সূক্ষ্ম এক সত্যানুভূতি যা যান্ত্রিকতা নির্ভর নয়, রাজনীতি নির্ভর নয়, এমনকি ভৌগলিকও নয়। যা সম্পূর্ণ মানবিক এবং সর্বকালের সর্বদেশের সকল মানুষের ঐক্য ও অভেদ অদ্বৈতবাদ দিয়ে গড়া।
“এই এই কনজিউমারিজম বা ভোগবাদ সকল আদর্শবাদের দুশমন। জাতীয় সংহতি, মানব সংহতি, ভাষার সংহতি কোনটাই এই ভোগবাদের অগ্নিশিখার সামনে দাঁড়াতে পারে না। ন্যাশনালিজম, সোশ্যালিজম, গণতন্ত্র, সাম্যবাদ, মানববাদ কারো রক্ষা নেই এই নবজাত ভোগবাদের অগ্নিশিখার সামনে।”
“মহাবীর, বুদ্ধ থেকে ইদানিং কালের যুগেপুরুষেরা প্রত্যেককেই এক একটা প্রচন্ড উত্তল ঢেউ, অনেক উত্থান পতন সেসব উত্তাল ঢেউতে ঘটেছে অনেক সাম্রাজ্য ও সভ্যতা উঠেছে আবার মাটির তলায় কোথায় বালি চাপা পড়ে আছে। এই ঢেউ গুলি সামান্য নয়, কিন্তু এই ঢেউ গুলিই মহাসমুদ্রে মিলিয়ে যায়, হয়তো একদম হারিয়ে যায় না।
“জাতীয় সংহতি মানব সংহতির বৃহত্তম আকাশ ও উদারতা ভিন্ন বর্তমান থাকতে পারে না। উদারতা, মানবিকতা ও মানুষত্ব বোধের উপাদানগুলই সর্বপ্রকার জনসমষ্টি বা জনগোষ্ঠীর সংহতির প্রাণবস্তু।”
“রাজনীতি হল ক্ষমতার সাধনা ও ব্যবহার। ক্ষমতার জন্যই রাজনীতি করা হয়, অর্থাৎ অহর্নিশি ক্ষমতা দখল ও ক্ষমতার রক্ষার অনির্বাণ সংগ্রাম। ‘ক্ষমতা’ এক নতুন ব্যাধি। এই ক্ষমতা রক্ষা ও ক্ষমতা পাবার জন্যই ঐতিহাসিক অনেক আবর্জনা দূর হচ্ছে না। জাতিভেদ, অস্পৃশ্যতা, সাম্প্রদায়িকতা, কুসংস্কার এসব তবে অতীত হয়ে যেত। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলিই তাদের ক্ষমতার স্বার্থে সেগুলিকে বাঁচিয়ে রেখেছে।”
“সুবিধাবাদী দলতান্ত্রিকতা। ও তথাকথিত সময়তান্ত্রিকতা প্রতিটি মানুষ, নর-নারীকে তার দায়-দায়িত্ব বোধ থেকে মুক্তি দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সেই দায় দায়িত্বহীন ব্যক্তি জীবন তাসের ঘর আজ সর্বত্র ভেঙ্গে পড়েছে, কি ধনতান্ত্রিক কি সমাজতান্ত্রিক, সকল দেশের ও সকল সমাজে। ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বা মহিমা ভিন্ন কোন আদর্শ সমাজ, আদর্শ পৃথিবী বা ‘কিংডম অফ হ্যাভেন অন আর্থ’ স্থাপিত হতে পারে না।”
“বর্তমান জগতে সাধারণ লোক যত অসহায়, কোন কিছু বিপর্যয়ের মুখে, এত অসহায় মানুষ কোন কালই ছিল না। আমাদের এই অসহায়তার একটা কারণ এই যে, আমরা আমাদের জন্য কোন ভূমিকা পালনের দায়-দায়িত্ব হাতে রাখিনি, সব দায়-দায়িত্ব উপর তলার নেতাদের ওপর সঁপে দিয়ে বসে আছি। বিশেষ করে যে অবস্থায় দেশের অর্থনীতি, শিল্প বাণিজ্য, যোগাযোগ ব্যবস্থা সবই বৃহৎ আকারের বৃহৎ মূলধনের ব্যাপার। যখন সমাজের নিম্নতম সংগঠনগুলি চালু ছিল, আমাদের প্রত্যেকের পক্ষে অর্থাৎ যখন গ্রামগুলি অনেকটাই সাবলম্বী ও সনিয়ন্ত্রিত ছিল, তখন প্রত্যেকেই দৈনন্দিন ব্যাপারে কিছু না কিছু সক্রিয় ভূমিকা নিতে পারত।”
“বস্তুত ধনতান্ত্রিক ও তথাকথিত সবাইতান্ত্রিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রে একটা মিল আছে। উভয়েই দেখাচ্ছে দরিদ্র মানুষের কাছে ভোগবাদের হাতছানি। কোন প্রথা বেশি ভোগ্যবস্তু কত সত্বর সকলের কাছে উপস্থিত হতে পারে, শেষ পর্যন্ত এই প্রতিযোগিতায় চলছিল তলে তলে ধনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের মধ্যে। জীবনযাত্রা ভঙ্গি বা লাইফস্টাইল ও জীবন সম্ভোগের লক্ষ্য একই। উভয়ই ইহালোক সর্বস্ব অনিবার্য এক ভোগবাদী সভ্যতার আকাশের তলায় এতকাল প্রতিযোগিতা করে এসেছে। এই প্রতিযোগিতায় যদি কিছু চক্ষুলজ্জাবোধ সমাজতন্ত্রে থেকে থেকে তা এই প্রতিযোগিতায় জেতার পক্ষে একটা দুর্বলতা, অন্তরায় মাত্র। যাদের কোন চোখ লজ্জা নেই, সেই ধনতান্ত্রিক অবাধ প্রতিযোগীরা এ সংসারে জিতবেই, শেষ পর্যন্ত জিতেছেও।”