বিষ্ণু দে ১৯০৯ সালের জুলাই মাসে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন।। তিনি ছিলেন একজন শিক্ষক, কবি ও সাহিত্যিক। অবশেষে ইনি ১৯৮২ সালের ডিসেম্বর মাসে স্বাধীন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কলকাতায় শেষ জীবন ত্যাগ করেন। এনার কিছু উপদেশ নীচে উল্লেখ করা হলো।
“যাকে এক ভঙ্গিতে আকস্মিক বা এলোমেলো ঘটনা মনে হয়, আর এক দিক থেকে তাই স্ট্যাটিস্টিকাল বা সংখ্যাবিজ্ঞানের নিয়মে প্রকাশিত।”
“কবিতা তো লেখাই হয় কাজের শব্দের প্রায় অবচেতন অর্থাৎ খানিকটা ব্যক্তির বাইরে নিজস্ব তাড়নায়। ভাষার প্রকাশ্য সত্তা শক্তি পায় কবিতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি কথার এই চেতন-অবচেতন সঞ্চারিত ধ্বনি ফল্গুস্রোতে।”
“ভাষার একটা স্বাভাবিক স্থিতিপ্রবণতার জন্য রচনার গতিতে আসে দ্বিধা। গতিতে গা ভাসালে অবশ্য খুঁটিতে বাঁধা মনের দ্বিধাও নিষ্প্রয়োজন। সজীব রচনাতে তাই শিল্পী ও শিল্পবস্তু, বিষয় ও টেকনিকে টান পড়ে জ্যা বদ্ধ ধনুকের টংকারে ধনু ও ছিলা টানের মতো ।”
“লোকশিল্প বাস্তববিরোধী নয়, বাস্তব পরিপক্ক পরোক্ষতা (আবস্ট্রাক্ট্ ফর্ম) আসলে তার লোকায়তিক মুক্তিই।”
“লৌকিক সংস্কৃতির আকর্ষণ যেন জীবন্ত মানুষকে আমাদের জাদুঘরের সামগ্রী না করে তোলে।”
“স্বর্গ সে তো চেতনার সিঁড়ি।”
“লোকনৃত্যের প্রেরণা ও প্রয়োগ অনেকখানি নির্ভর করে তার সামাজিক উপলক্ষে। শহুরে মঞ্চের উপরে অনেক নৃত্যই মানায় না, অধিকন্তু দর্শকরা তার প্রেরণায় অংশ নিতে অক্ষম”
“লাঙল ফলায় চেতনাকে করো উর্বর তবে তো ফলবে জ্ঞান-বিজ্ঞানে মনের ফসল, তবে তো গড়বে যন্ত্র হাতের দরদে সচল।”
“বন্ধুত্বের পারস্পরিকতায় যে কথা মুখে বলা যায়, সে কথা কাগজের শীতল প্রকাশ্যতায় লেখা অর্থহীন।”
“সাময়িক আনন্দ ছাড়া আরেক দিক থেকে লোকনৃত্যের সার্থকতা স্পষ্টতর ; সেটা হচ্ছে নৃত্যের রূপশিক্ষার দিক, নতুন নৃত্য-প্রেরণায় যার প্রভাব কার্যকর হবে। বিশেষ করে আজ যখন আমরা জানি যে শিক্ষায় শরীরের ছন্দশিক্ষার মূল্য প্রাথমিক। এই ছন্দশিক্ষায় আমরা যত বেশি লোকনৃত্য দেখতে পারি এবং স্থানকালপাত্র ভেদে ও ক্ষমতানুসারে তার থেকে পাঠ নিতে পারি, ততই লাভ। তাছাড়া, আমরা এবং আমাদের ছেলেমেয়েরা কেন নিছক সৌন্দর্য দর্শনের সুযোগ পাব না?”
“মনের বালাই বড়ো, বহু দাবি-দাওয়া সে জানায়।”
“আপন সমস্যাকে শুধু নিজের মনের গহ্বর নিষ্ক্রান্ত জীব না ভেবে সে যে ইতিহাসব্যাপী সমস্যারও অংশ—এই উপলব্ধির নিয়ত চর্চা লেখকের প্রস্তুতির সহায়।”
“সূর্য ফেরে প্রত্যহই সহিষ্ণু আস্থায় উদয়—শিখরে।”
“শিল্পী জানে, কবি জানে, যেহেতু প্রেমিক তারা তাই জানে দ্বন্দ্বের যন্ত্রণা, জানে সমাধা দুরূহ, তবু আশা দুর্মর।”
“সভ্যতার আর একটি বড় প্রত্যয় হচ্ছে ব্যক্তিত্ববোধ। কি করে সমাজ ও ব্যক্তিতে দ্বন্দ্বাশ্রয়ী সম্বন্ধের দীর্ঘ ইতিহাসে এই ব্যক্তির স্বরূপ মর্যাদা পেতে লাগল, তার ব্যাখ্যা সভ্যতার ইতিহাস। বহির্জগতের বিরুদ্ধশক্তি, অন্ধপ্রকৃতি, জন্তু-জানোয়ার, হিংস্র-গোষ্ঠীর দলাদলি যতদিন না মানুষের শুভবুদ্ধি কর্তৃত্বে রূপান্তরিত হবার সম্ভাবনা পেয়েছে ততদিন ব্যক্তির এই মহিমা কবিদের মনেও আসেনি। বাল্মীকি বা হোমার গোষ্ঠীর রচনাই করেছেন, রবীন্দ্রনাথই বলতে পেরেছেন স্বকীয়তার কথা।”
“শব্দের অর্থের ছন্দের স্বরের দ্বন্দ্বে রূপান্তর চাই, শব্দে শব্দে আপতিক ভেদাভেদ অতিক্রমে কবিতায় কবিতায় স্বাতন্ত্র্যের অনন্য ও অন্যোন্যের যোগাযোগে অর্থের বিন্যাস।”