শ্রীমৎ কিরণচাঁদ দরবেশ ১৮৭৮ সালের আগস্ট মাসে বর্তমান বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ১৯১২ সালে তিনি সন্ন্যাস জীবন গ্রহণ করেছিলেন। তুমি একদিকে ছিলেন যেমন ধর্মের প্রতি আগ্রহী তেমনি অপরদিকে ছিলেন একজন কবি। মন্দির কাব্যগ্রন্থটি তিনি রচনা করেছিলেন। ইনি একজন বৈষ্ণব লোকশিক্ষাব্রতী সাধক ছিলেন। অবশেষে তিনি ১৯৪৬ সালে ভারতের বারাণসিতে মারা যান।
“নিজেকে কোনো সম্প্রদায়ভুক্ত মনে করবে না। বৈষ্ণব, শৈব ও শাক্ত একই। ‘সৎ’ যার কাছে আদর পায়, ‘অসৎ’ যার কাছে বিন্দুমাত্র প্রশ্রয় পায় না, তাকেই সাধু বলে।”
“সন্দেহের ঘাত-প্রতিঘাত না থাকলে মানব মনে যথার্থ জিজ্ঞাসার উদয় হতো না।…..যার প্রাণে জিজ্ঞাসা এসেছে ভগবানের দরবারের দরজা তার কাছে উন্মুক্ত হয়েছে।… যতো বড় সংশয়ই আসুক না কেন, সৎসঙ্গ করলে কল্যাণ হয়। … অবসর পেলে সদগ্রন্থ পাঠ করা উচিত।”
“সব কাজ তাঁর-এইটি বুঝে যে ব্যক্তি কাজ ও পূজাকে এক মনে করতে পারে, তার পক্ষে অনন্যভাবে ভগবৎচিন্তা সম্ভব।”
“ক্রিয়মান কর্ম দ্বারা কখনো প্রারম্ভের ভোগ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায় না; তবে প্রারম্ভের প্রখরতা কমে যেতে পারে। কেবল সাধনা দ্বারা ভোগের ক্ষয় হয় না, ভোগ দ্বারাও ভোগের ক্ষয় হয়।…। বৈধভাবে বিষয় ভোগ করলে ধীরে ধীরে বাসনা কমে। অবৈধ ভোগ করলে তা আর ভোগ থাকে না, তার নাম উপভোগ। ওই উপভোগ সর্বনাশ হয় এবং ক্রমশঃ বাসনা আরও বাড়ে।”
“আমরা প্রত্যেকে সম্পূর্ণ একা, দ্বিতীয় কেউ আমাদের কার্যাকার্যের জন্য দায়ী নয়। মাত্র দু-জন, তুমি ও তিনি। …। শুধু বিগ্রহ নয়, যে কোনো মানুষকে প্রণাম করতে হলেও ‘আমার ইষ্টদেব এঁর মধ্যে বিরাজ করছেন’—এই বুদ্ধিতেই প্রণাম করতে হবে। ইষ্টদেব ছাড়া এ জগতে আর কেউ প্রণম্য নেই।”
“অন্যান্য বৃত্তি ও বাসনায় খেলা দেহমনে যাই হোক, নাম-নামদাতা নামীতে অনুরাগই উন্নতি বুঝবার প্রকৃষ্ট উপায়। এই অনুরাগবিহীন হয়ে কেউ যতোই জিতেন্দ্ৰিয় হোক না কেন, প্রত্যহ হরিনামে কাঁদন-নাচন হোক না কেন, কিছুতেই অগ্রসর হয় না।”
“খুব বুঝে শুনে কোনো সঙ্কল্প করবে। সৎকর্মও অনেক সময় বন্ধনের কারণ হয়, যে যতোটুকু কারণ হয়। যে যতোটুকু বইতে পারো, তার ততোটুকুই গ্রহণ কর্তব্য। যতোটুকু কর্তব্য, ঠিক ততোটুকুই করবে, আসক্তিবশে করবে না।…..একমাত্র ভগবান ছাড়া কেউ কারো নয়। আসক্তি যা কিছু সব তাঁর দিকে। সব কর্তব্য প্রসন্নমনে করবে। প্রতি কর্ম সাধনের অঙ্গ বলে মনে করবে, এরূপভাব মনে রাখলে কর্মবন্ধন থেকে মুক্ত হবে।…..বিরক্তিভাবে করলে হবে না।”
“শুধু নামসাধন করলেই হবে। নামই যথাস্থানে নিয়ে যায়। নাম করার সময় শ্বাসের দিকে দৃষ্টি রাখতে হয়। … নামকে শ্বাসের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়াই সাধন, শ্বাসকে নামের সঙ্গে মিল করা নয়। … বাইরের এ শ্বাস নয়, স্রোত আসে। ওটিই যথার্থ নামের পথ। ওইটি ধরবার জন্যই বাইরের শ্বাসকে অবলম্বন করতে হয়। বাইরের শ্বাসের সঙ্গে ওই ভেতরের শ্বাস এলে তখন বাইরের যোগ রাখার চেষ্টা অনাবশ্যক। …নাম ধরে থাকলে যখন নামময় হয়ে যাবে, অর্থাৎ প্রতি শ্বাসে নাম হবে, যেন নামই প্রবাহিত হচ্ছে। শ্বাস প্রশ্বাস নয়, এখন লক্ষ্যে পৌঁছবে। যেহেতু নাম, নামী এক, তাই যখন নাম-ময় হবে, তখন নামীকেও পাবে। যে ব্যক্তি যে ভাবের, সে ভগবানে সেই ভাবের আস্বাদন পাবে।”