Pramatha Chaudhuri Motivation Quotes | প্রমথ চৌধুরীর ৩০টি মোটিভেশন বাণী

প্রমথ চৌধুরী 1868 সালের আগস্ট মাসে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের যশোরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এনার ছদ্মনাম ছিল বীরবল। নিয়েছিলেন শিক্ষক, কবি এবং লেখক। অবশেষে ১৯৪৬ সালের অক্টোবর মাসে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের কলকাতায় শেষ জীবন ত্যাগ করেছিলেন। ইনার কিছু উপদেশ নীচে উল্লেখ করা হলো।

Pramatha Chaudhuri Motivation Quotes
Photo from pexels.com

“অতি বিজ্ঞাপিত জিনিসের প্রতি আমার শ্রদ্ধা অতি কম। কারণ, মানবহৃদয়ের স্বাভাবিক দুর্বলতার ওপর বিজ্ঞাপনের বল এবং মানবমনের সরল বিশ্বাসের ওপর বিজ্ঞাপনের ছল প্রতিষ্ঠিত।”

“এদেশে লাইব্রেরির সার্থকতা হাসপাতালের চাইতে কিছু কম নয় এবং স্কুল-কলেজের চাইতে কিছু বেশি।”

“সমালোচনা এখন বিজ্ঞাপনের মূর্তি ধারণ করেছে। তার থেকে বোঝা যায় যে, যাতে বাজারে বইয়ের ভালোরকম কাটতি হয় সেই উদ্দেশ্যে আজকাল সমালোচনা লেখা হয়ে থাকে নারী বাদ।”

“আমরা যাকে উঁচুদরের কাব্য বলি তার ভিতরকার কথা হচ্ছে না দিয়ে ট্রাজেডি হয় না, কমেডিও হয় না।”

“ভাষার বর্তমান অবস্থা এই যে এক শব্দ শুধু একটি ভাবের প্রকাশ করেই ক্ষান্ত থাকে না, কিন্তু তার সঙ্গে অনেক অস্পষ্ট মনোভাবকে জাগিয়ে তোলে। একটা উপমার সাহায্যে কথাটা পরিষ্কার করা যাক। সেতার, এসরাজ প্রভৃতি যন্ত্রে দেখা যায় যে, এমন অনেকগুলি তার আছে, যেগুলিকে বাদক স্পর্শ করে না। এ তারগুলিকে যন্ত্রীরা তরফের তার বলে। যে তার বাদক স্পর্শ করে, সেই তারের ধ্বনি ওই অদৃশ্য তরফের তারের বেতার বার্তা আনে বলেই স্পষ্ট তারের ধ্বনি তার সৌন্দর্য ও ঐশ্বর্য লাভ করে। নিজ ভাষায় কাব্য আমাদের মনোবীণায় যে ঝঙ্কার তোলে, কোনো বিদেশির মনে সে ঝঙ্কার তুলবে না। কারণ আমাদের মনে যে সব তরফের তার আছে, বিদেশির মনে সে সব নেই।”

“লেখক এবং পাঠকের মধ্যে এখন স্কুলমাস্টার দণ্ডায়মান। এই মধ্যস্থদের কৃপায় আমাদের সঙ্গে কবির মনের মিলন দূরে যায়। চার চক্ষুর মিলনও ঘটে না।”

“শিক্ষা কেউ কাউকে দিতে পারে না। সুশিক্ষিত লোক মাত্রেই স্বশিক্ষিত।”

“উন্নতি যে পদে পদে অবনতি সাপেক্ষ তার বৈজ্ঞানিক প্রমাণ আছে।”

“আমাদের কাজের কথায় যখন কোনো ফল ধরে না তখন বাজেকথার ফুলের চাষ করলে হানি কি?”

“পুরাকালে মানুষ যা কিছু গড়ে গেছে তার উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে সমাজ হতে আলগা করা, দু-চারজনকে বহু লোক হতে বিচ্ছিন্ন করা। অপরপক্ষে নবযুগের ধর্ম হচ্ছে মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলন করা, সমগ্র সমাজকে ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ করা, কাউকেই ছাড়া নয়, কাউকেই ছাড়তে দেওয়া নয়।”

” একমাত্র আনন্দের স্পর্শেই মানুষের মনপ্রাণ সজীব, সতেজ ও সরাগ হয়ে ওঠে। সুতরাং সাহিত্যচর্চার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হওয়ার অর্থ হচ্ছে জীবনীশক্তি হ্রাস করা।”

“বড়োকে ছোটোর ভিতর ধরে রাখাই হচ্ছে আর্টের উদ্দেশ্য। অন্ধকারেরও একটা অটল সৌন্দর্য আছে এবং তার অন্তরেও গুপ্তশক্তি নিহিত থাকে। যে ফুল দিনে ফোটে, রাত্রে তার জন্ম হয়—এ কথা আমরা সকলেই জানি। সুতরাং নবযুগে যে সকল মনোভাব প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছে তার অনেকগুলির বীজ মধ্যযুগে বপন করা হয়েছিল।”

“স্বরগ্রাম কোনো পুরুষ কর্তৃক রচিত হয়নি, প্রকৃতির বক্ষ থেকে উত্থিত হয়েছে। একটি একটানা তারের গায়ে ঘা মারলে প্রকৃতি অমনি সাত সুরে কেঁদে ওঠেন। এর থেকে বৈজ্ঞানিকেরা ধরে নিয়েছেন যে, প্রকৃতি তাঁর একতারায় যে সকাতর সার্গম আলাপ করেন মানুষ শুধু তার নকল করে। কিন্তু সে নকলও মাছি মারা হয় না। মানুষের গলগ্রহ কিংবা যন্ত্রস্থ হয়ে প্রকৃতিদত্ত স্বরগ্রামের কোনো সুর একটু চড়ে, কোনো সুর একটু ঝুলে যায়। তা তো হবারই কথা। প্রকৃতির হৃদয়তন্ত্রী থেকে এক ঘায়ে যা বেরোয় তা যে একঘেয়ে হবে—এতো স্বতঃসিদ্ধ। সুতরাং মানুষের এইসব প্রকৃত সুরকে সংস্কৃত করে নিতে বাধ্য।”

“খেয়ালী লেখা বড় দুষ্প্রাপ্য জিনিস। কারণ সংসারে বদখেয়ালী লোকের কিছু কমতি নেই। কিন্তু খেয়ালী লোকের বড়ই অভাব। অধিকাংশ মানুষ যা করে তা আয়াসসাধ্য, সাধারণ লোকের পক্ষে একটুখানি ভাব অনেকখানি ভাবনার ফল। মানুষের পক্ষে চেষ্টা করাই স্বাভাবিক, সুতরাং সহজ। স্বতঃউচ্ছ্বসিত চিন্তা কিংবা ভাব শুধু দু-একজনের নিজ প্রকৃতিগুণে হয়।

যা আপনি হয় তা এতই শ্রেষ্ঠ ও এতই আশ্চর্যজনক যে, তার মূলে আমরা দৈবশক্তি আরোপ করি, এ জগৎসৃষ্টি ভগবানের লীলা বলেই এত প্রশস্ত এবং আমাদের হাতে-গড়া জিনিস এত কষ্টসাধ্য বলেই এত সংকীর্ণ। তবে আমাদের সকলেরই মনে বিনা ইচ্ছাতেও যে নানাপ্রকার ভাবনাচিন্তার উদয় হয়, এ কথা অস্বীকার করবার জো নেই। কিন্তু সে ভাবনাচিন্তার কারণ স্পষ্ট এবং রূপ অস্পষ্ট। “

রোগ শোক দারিদ্র্য প্রভৃতি নানা স্পষ্ট সাংসারিক কারণে আমাদের ভাবনা হয় ; কিন্তু সে ভাবনা এতই এলোমেলো যে অন্যে পরের কথা, আমরা নিজেরাই তার খেই খুঁজে পাইনে। যা নিজে ধরতে পারিনে, তা অন্যের কাছে ধরে দেওয়া অসম্ভব ; যে ভাব আমরা প্রকাশ করতে পারিনে, তাকে খেয়াল বলা যায় না। খেয়াল অনির্দিষ্ট কারণে মনের মধ্যে দিব্য একটা সুস্পষ্ট সুসম্বন্ধ চেহারা নিয়ে উপস্থিত হয়। খেয়াল রূপবিশিষ্ট, দুশ্চিন্তা তা নয়।”

“ভুল করেছি—এই জ্ঞান জন্মানো মাত্র সেই ভুল তৎক্ষণাৎ সংশোধন করা যায় না। কিন্তু মনের স্বাধীনতা একবার লাভ করিতে পারিলে ব্যবহারের অনুরূপ পরিবর্তন শুধু সময়সাপেক্ষ ।”

“তাঁকেই যথার্থ-সমালোচক বলে স্বীকার করি, যিনি সাহিত্যরসের যথার্থ রসিক।”

“যে লেখায় লেখকের মনের ছাপ নেই, তা ছাপলে সাহিত্য হয় না।”

“রিয়ালিজমের পুতুলনাচ এবং আইডিয়ালিজমের ছায়াবাজি উভয়েই কাব্যে অগ্রাহ্য। আমরা মুখে কি বলি, তার চাইতে আমরা মনে কি ভাবি তার মূল্য আমাদের কাছে ঢের বেশি ; কেননা সত্যের জ্ঞান না হলে মানুষ সত্য কথা বলতে পারে না।”

“প্রাচীন ভারতবর্ষও রূপ সম্বন্ধে অন্ধ ছিল না ; কেননা, আমরা যাই বলি না কেন, সে সভ্যতাও মানবসভ্যতা —একটা সৃষ্টিছাড়া পদার্থ নয়। সে সভ্যতারও শুধু আত্মা নয়, দেহও ছিল এবং সে দেহকে আমাদের পূর্বপুরুষেরা সুঠাম ও সুন্দর করেই গড়তে চেষ্টা করেছিলেন। সে দেহ আমাদের চোখের সম্মুখে নেই বলেই আমরা মনে করি যে, সেকালে যা ছিল তা হচ্ছে—শুধু অশরীরী আত্মা। কিন্তু সংস্কৃত সাহিত্য থেকেই প্রমাণ পাওয়া যায় যে তাঁদের কতটা সৌন্দর্যজ্ঞান ছিল।

আমরা যাকে সংস্কৃত কাব্য বলি, তাতে রূপবর্ণনা ছাড়া আর বড় কিছু নেই আর সেই রূপ বর্ণনাও আসলে দেহের, বিশেষত, রমণীদের বর্ণনা। আমাদের পূর্বপুরুষেরা কিন্তু সে সৌন্দর্যকে একটি অমূল্য বস্তু বলে মনে করতেন ; শুধু স্ত্রীলোকের নয়, পুরুষের রূপের উপরও তাঁদের ভক্তি ছিল। যাঁর আলোক সামান্য রূপ নেই, তাঁকে এদেশে পুরাকালে মহাপুরুষ বলে কেউ মেনে নেয়নি। শ্রীরামচন্দ্র, বুদ্ধদেব, শ্ৰীকৃষ্ণ প্রভৃতি অবতারেরা সকলেই সৌন্দর্যের অবতার ছিলেন।”

“বহু মানবের বহুদিন ধরে কায়মনোবাক্যে যে সভ্যতা গড়ে তুলেছে তার ভিতর  যে মনুষ্যত্ব নেই একথা বলতে শুধু তিনিই অধিকারী যিনি মানুষ নন। অপরপক্ষে ‘চরমসভ্যতা’ বলে কোনো পদার্থ, মানুষে আজ পর্যন্ত সৃষ্টি করতে পারেনি এবং কখনো পারবে না। কেননা, পৃথিবী যে-দিন স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠবে সে-দিন মানুষের দেহমনের আর কোনো কার্য থাকবে না, কাজেই মানুষ তখন চিরনিদ্রা উপভোগ করতে বাধ্য হবে।”

অন্তত পৃথিবীতে এমন কোনো সভ্যতা আজ পর্যন্ত হয়নি, যা একেবারে নির্গুণ কিংবা একেবারে নির্দোষ। কোনো একটি বিশেষ সভ্যতার বিচার করবার জন্য তার দোষগুণের পরিচয় নেওয়া আবশ্যক, মনকে ঘাটানো দরকার। প্রতি কবির মন এক-একটি স্বতন্ত্র রসের উৎস। কবির কার্য হচ্ছে সামাজিক মনকে সরল করা। কবির মনের সঙ্গে অবশ্য সামাজিক মনের আদান-প্রদানের সম্পর্ক আছে।”

কবি কিন্তু সমাজের নিকট হতে যা গ্রহণ করেন, সমাজকে তার চেয়ে ঢের বেশি দান করেন। যদি কেউ প্রশ্ন করেন যে, কবি এই অতিরিক্ত রস কোথা হতে সংগ্রহ করেন? তার উত্তরে আমরা বলব, আধ্যাত্মিক জগৎ হতে, সে জগৎ অবাস্তবও নয় এবং তা কোনো পরম ব্যোমেতেও অবস্থিতি করে না। সকলেই মরে, কিন্তু সকলেই আর প্রেমে পড়ে না।”

“পৃথিবীতে যতদিন দরিদ্র আর ধনী থাকবে, ততদিন আইন-কানুন সবই থাকবে এবং আইন কানুনের রক্ষক পুলিশও থাকবে। সমাজ তো দরিদ্রকে দরিদ্রই রাখতে চায়, আর ধনীকে ধনী। এই দু’য়ের পার্থক্য বজায় রাখাই তো সকল আইন-কানুনের উদ্দেশ্য।

“উকিল সমাজের একটা নীতি অথবা রীতি আছে যা সকলেই মান্য করে, সকলেই পরের ব্রিফকে পরস্ত্রীর মতো দেখে, অর্থাৎ কেহই প্রকাশ্যে তার দিকে নজর দেয় না।”

” প্রাচীন গ্রিক সভ্যতার বিশেষত্ব এই যে তা ছিল একাধারে ডোমোক্রাটিক এবং অ্যারিস্টোক্রাটিক। সেই কারণেই গ্রিক সাহিত্য এত অপূর্ব, এত অমূল্য। সে সাহিত্যে আত্মার সঙ্গে আর্টের কোনো বিচ্ছেদ নেই, বরং দুয়ের মিলন এত ঘনিষ্ঠ যে বুদ্ধিবলে তা বিশ্লিষ্ট করা কঠিন ।”

“সাহিত্যের হাসি শুধু মুখের হাসি নয়, মনেরও হাসি। এ হাসি হচ্ছে সামাজিক জড়তার প্রতি প্রাণের বক্রোক্তি, সামাজিক মিথ্যার প্রতি সত্যের বক্রদৃষ্টি।”

“প্রেম বস্তুটি হচ্ছে মূল্যহীন ফুলের বিনিসুতোর মালা।”

“শ্রুতির অর্থ হচ্ছে সেই স্বর যা কানে শোনা যায় না, যেমন দর্শনের অর্থ হচ্ছে সেই সত্য যা চোখে দেখা যায় না। যেমন দর্শন দেখবার জন্য দিব্যচক্ষু চাই, তেমনি শ্রুতি শোনবার জন্য দিব্যকৰ্ণ চাই।”

Leave a Reply