লোকমাতৃকা আনন্দময়ী ১৮৯৬ সালের এপ্রিল মাসে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় ( বর্তমানে বাংলাদেশ ) জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ইনি নির্মলা সুন্দরী নামেও পরিচিত ছিলেন। ইনি একদিকে সন্ন্যাসিনী এবং অপরদিকে তন্ত্র দর্শনে আকৃষ্ট ছিলেন। এনার নামে অনেক বিদ্যাপীঠ, মন্দির ও হসপিটাল তৈরি হয়েছে। অবশেষে ১৯৮১ সালের আগস্ট মাসে স্বাধীন ভারতের দেরাদুনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এনার কিছু আধ্যাত্মিক বাণী নিজে উল্লেখ করা হলো।
Photo from Pixabay
“বাইরের পুস্তক পড়লে যেমন বাইরের বিষয় জ্ঞান লাভ করা যায় তেমনি সকলের ভেতরে একখানা করে ‘বই’ আছে তা পড়বার চেষ্টা করো …তখন নিজেই বুঝতে পারবে।”
“আসলে ত্যাগ বলে কিছু নেই; মানুষ কেবল খণ্ড (অনিত্য) ভোগ থেকে পরিপূর্ণ ভোগের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। …. তাঁকে পেতে হলে ভোগ ত্যাগের ওপরে উঠতে হয়।
“এক হয়েও তিনি -বহু এবং বহু হয়েও তিনি এক। এইই তাঁর লীলা।”
“নির্ভরতা কিংবা আত্মবিচারের ওপর দৃঢ়তা নিয়ে শুদ্ধভাবে উৎকর্ষ সাধন করো, কর্ম থাকলেও ‘অহং’ -এর উদ্বেগ ক্রমশঃ কমে আসবে।”
“দৈহিক মৃত্যুর পর বাসনা-কামনাসহ সূক্ষ্মশরীর (নিয়ে)— মানুষ নিজ ‘কর্ম’ অনুসারে জন্ম নেয়। বাসনাজড়িত ‘আমি’ বা ‘অহমিকা’ যায় আসে। আত্মার যাওয়া আসার প্রশ্ন নেই। স্থূল, সূক্ষ্ম, কারণ, কারণেই কারণ আত্মা। তার প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত আসা-যাওয়া। আত্মা স্বয়ংপ্রকাশ। ‘আসা-যাওয়া’ জীবের নিজেকে প্রকাশ করার জন্য পরদা সরানো মাত্র।”
“যে যা করছো সেটাও তাঁর সাধনা। যার ভোগাকাঙ্খা আছে, তার ভোগ করতে করতে ভোগ কেটে যায়। তখন তাঁকে ডাকতে ইচ্ছা হয়। ‘আমিত্ব’ থাকা পর্যন্ত ইচ্ছা-অনিচ্ছা ওঠে। ‘আমিত্ব’ গেলে সব ঘুচে যায়।”
“আধ্যাত্মিক জীবন লাভ করবার ইচ্ছা বাস্তবিকই যদি কারোর মধ্যে জেগে ওঠে, তখন ওই পথে যেতে হলে যা যা দরকার, আপনি এসে জুটবে।… স্বাভাবিক গতিতে চলা দরকার, অস্বাভাবিক গতিতে কোনো কাজ হয় না। …অধিকারী ভেদে উপদেশ ভিন্ন হয়ে থাকে।”
“আমি দেখি জগৎ ভরা একটি বাগান; জীব-জন্তু, উদ্ভিদাদি যত কিছু আছে, সবই এই বাগানে নানা রকম খেলছে। প্রত্যেকেরই একটি বিশিষ্টতা আছে, তাই দেখে আমার আনন্দ।”
” কর্মে শুধু তাঁরই সেবা হচ্ছে এই ‘ভাবে’ যে স্থিতিলাভ করতে পারে, সে কর্তব্যরতের শেষ করে ফলাফলের আশায় ফিরে চায় না।”
“যে যে পথটি ধরে আছো, সেই পথেই শুদ্ধভাবে পরিপূর্ণ লাভের জন্য পুরুষাকার প্রয়োগ করো। লক্ষ্য যখন প্রাণময় হতে থাকবে, যার যা আবশ্যক ‘আপসে আপ হো যায়গা’।”
“ভক্তি, কর্ম, জ্ঞান, বিচার— এই চারটে একত্রেই থাকে। এর কোনোটি অপরগুলি হতে একটু বেশি প্রকাশ পেলে তা দিয়ে আমরা মানুষের প্রকৃতি ঠিক করি। ভক্তির ভাব বেশি হলে ‘ভক্ত’ বলি।”
“জগতে যা কিছু হচ্ছে, তা-ই ভগবানের স্বাভাবিক স্ফুরণ থেকে হচ্ছে। এটি যে তাঁর স্বভাব। …সৃষ্টিও অনাদি, কর্মও অনাদি। …তাঁর লীলা।
“কোন্ মুহূর্তে সেই জ্ঞানের যোগ আসবে কে বলতে পারে, … কোন্ মুহূর্তে কার অনুভবে ভগবান প্রকাশ দেন কেউ বলতে পারে না।”
“যে ‘অহং’ বা স্বাতন্ত্র্যবুদ্ধির স্ফূর্তির দ্বারা জীব (নিজেকে) ভগবান হতে বিচ্ছিন্ন মনে করেছে, তা সমূলে উৎপাটন করবার জন্য ইচ্ছাশক্তির প্রয়োগ নিতান্ত আবশ্যক। …. পরমেশ্বরে যার ‘আমিত্ব’ লয় পেয়েছে সে দৈব বা “মহা নিয়তি”র অধীন থাকতে পারে, কিন্তু যার ‘আমি কর্তা’ এই অভিমান রয়েছে, তার সকল কাজেই ‘পুরুষকার’ আবশ্যক। যতক্ষণ বুদ্ধির পরিচালনা আছে, ততক্ষণ ‘অহং’ আছে, ‘কর্ম’ও আছে।
“প্রারব্ধ আছে, আবার প্রারব্ধের ওপরও এক স্থিতি আছে, যেখানে অধিকারী-অনাধিকারীর কথা নেই।”
“ধ্যানে যেমন লক্ষ্যবস্তু প্রকাশ, আবার বিচারেও নিজ লক্ষ্য প্রকাশ হয়। ধ্যান ও বিচার কোনো কর্মের অধীন নয়, ধ্যানে যার রুচি গুরুনির্দেশে তাই নিয়ে চলতে হবে। আর তত্ত্ববিচারে যার রুচি তার সর্বদা তত্ত্ববিচার করে যাওয়া (প্রয়োজন)।”
“পুরুষকার কাকে বলে? তিনি যা করান তা-ই পুরুষকার। এসবই যে তারই লীলা। (অহংকৰ্তৃত্ববোধক) ভ্রান্তি রূপেও যে তিনিই।”
“এ জগৎ একটা মৃদঙ্গের মতো। এর বাদক একজনই। সে যে বোল বাজায় সেই বোল (জগৎ) বলে।”
“শাস্ত্রে আর কতটুকু লিখতে পারে। প্রত্যক্ষদর্শীরা আরো কত কী দেখেন, জানেন। শাস্ত্রে সাধন রাজ্যের সমস্ত কথা নেই, মাত্র কয়েকটি অবস্থার কথা আছে। শাস্ত্রের কথাগুলি যে সাধন রাজ্যের শেষ কথা, এরূপ অনুমান করা ভুল।”
“সকলেই এক জায়গায় যাবে। কিন্তু যে যেখানে আছো, তাকে সেখানে থেকেই চলতে হবে। এই জন্যই প্রত্যেকের এক পথ নয়। উদ্দেশ্য যদিও এক। মনটাকে ‘তার’ চরণ ছাড়া রেখো না। তাহলেই সবদিকের প্রলোভন থেকে বাঁচার আশা।”
“গতি ও স্থিতি রূপেতে যিনি, তিনিই অক্ষর রূপেতে—যা ক্ষরণ হয় না।অমর আত্মা অমরপন্থী স্বয়ং আপনাতে আপনি।”
“কে কার সংসারে? যার যার কর্ম সম্পূর্ণ করে, যাত্রা পূর্ণ করতে চেষ্টা করে।”
“যতক্ষণ অহং বুদ্ধি থাকে, ‘আমি কিছু করছি, করতে পারি—এই বিশ্বাস থাকে, ততক্ষণ কাজে লেগে থাকা। যেদিকে চেষ্টা করবে, সেদিকেই অগ্রসর হতে থাকবে। কারণ ছাড়া তো কার্য হয় না। কর্ম ও কর্ম কর্মফল আছে।—অহংবুদ্ধি চলে গেলে কিছুই থাকে না, তখন নিজেকে তাঁর হাতের যন্ত্র বলে মনে করে।”
“নিয়মিত জপ করে যাও। জাগরণ হতেই হবে। না হয়ে পারে না। …ধৈর্য তিতিক্ষার আশ্রয়ে, তাঁর সন্ধানে প্রসন্ন মনে অবাধ গতিতে চলার চেষ্টা করো।”
“তরঙ্গশূন্য যে স্থিরত্ব, তার আভাস পেতে হলে সব সময়েই সেই তরঙ্গরূপী শ্বাস প্রশ্বাস, তার দিকে স্থির লক্ষ্যে মনটা রাখলে সহায়ক হয়।”
“নিজের শরীরকে তাঁরই মন্দির বলে ভাবনা করো। …শরীরকে যত্ন করো।”
“রাগ-দ্বেষ সব হয় (দ্বৈত বা) দুই ভাব থেকেই। …ব্যক্তিস্বাতন্ত্র ঘুচে গিয়ে অহং-কার নাশ হয়ে গেলে স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে প্রকাশ পায় ‘মৌন’ (দ্বন্দ্বাতীত, গুণাতীত শান্তস্বরূপ বোধ)।”
“যিনি অবতার, তিনি কোনো নিয়মেরই অধীন হন না। যদিও ঠিক ভাবে সবই তাঁর মধ্য দিয়ে হয়ে যায়, কিন্তু তিনি কোনোটিতেই বদ্ধ থাকেন না। …জীব উচ্চস্তরে যেতে যেতে ‘ভগবানের মতো’ হয়, আর ভগবানের অবতারে ‘জীবের মতো’ ব্যবহারের প্রকাশ দেখা যায় মাত্র। ….অবতারের মধ্যে চল ও অচল দুই ভাবেরই খেলা চলে।”
“ভগবানের অনন্ত ভাব, অনন্ত রূপ, অনন্ত গুণ ; আবার তাঁর মিলনের রাস্তাও অনন্ত । কেবলমাত্র তাঁর সঙ্গে যে নিত্য মিলনে রয়েছো, তা জানার জন্য তীব্র ব্যাকুলতার আশ্রয়ে উন্মুখ হয়ে থাকা।”
” ‘আমি’ অনন্ত গতিরূপে, “আমি” এক, আবার “আমি” ই বাহরূপে প্রকাশে— ‘অখন্ড মণ্ডলাকার’ আর কি। ‘সাক্ষী—স্বরূপ’ কথাটি তিন অর্থে ব্যবহার করা যায়। প্রথম, ‘সাক্ষীর মতো’ কিন্তু প্রকৃত সাক্ষী নয়; দ্বিতীয় প্রকৃত সাক্ষী, কিন্তু এখানে দ্বৈতজ্ঞান আছে; এবং তৃতীয়, সাক্ষীস্বরূপ অর্থাৎ ব্রহ্মস্বরূপ, এখানে এক ব্রহ্ম ভিন্ন দ্বিতীয় কিছু নেই।”
“দুর্লভ মনুষ্য জন্ম—বৃথা একটি মুহূর্তও যেন না যায়। মনটাকে শুদ্ধ পবিত্র করতে চেষ্টা করো। নিয়মিত উপাসনার দ্বারাই চিত্তশুদ্ধি হয়। যার যে ভাবে ভালো লাগে চেষ্টা করো।”
“এদিকের (জাগতিক) মজা আর কটুকু। ওই দিকের (আধ্যাত্মিক) মজার একটু আস্বাদ পেলেই আর এদিকের মজা পাওয়ার ইচ্ছা হবে না।”
“সকল বিষয়ের মূলরূপে যিনি বর্তমান, তাঁর অনুসন্ধান করো—এটিই তপস্যা। এটিই সাধনা ৷”
“পরিবর্তন রূপে, অপরিবর্তন রূপে তিনিই স্বয়ং। …প্রকৃতি হলো ক্রিয়াশীল আর পুরুষ হলো নির্বিকার।”
“যতক্ষণ চেষ্টার বুদ্ধি আছে, ততক্ষণ চেষ্টা করতেই হবে। চেষ্টা করতে করতে বিশুদ্ধ বুদ্ধি এবং বিশুদ্ধ ভাব উদয় হয়। …এই বিশুদ্ধ ভাব জাগলেই লোকে বুঝতেপারে, আর কর্মের মধ্যে কোনো সার নেই। তখন সে ভগবানের হাতের পুতুলহয়ে যায়। এই বিশুদ্ধ ভাব জাগাতে হলে একটা পথ অবলম্বন করে থাকতে হয়। সে ভাবটি দ্বৈতভাবেরই হোক বা অদ্বৈতভাবেরই হোক তাতে কিছু আসে যায় না। ‘আমিই সব’ বা ‘তুমিই সব’ এই রূপ একটি ভাব নিয়ে পড়ে থাকতে হয়। এইভাবে থাকতে থাকতে দেখা যায় তখন আর দুটি নেই। ‘আমি আছে, অথবা ‘তুমি’ আছে। এক অখণ্ড সত্তায় তখন সব লয় পায়। এই-ই ব্রহ্মের অনুভূতি, এই-ই ভগবানকে লাভ করা। কথাতে এটি প্রকাশ করা যায় না। এটি বোঝাবার জন্যই শুধু ‘লাভ-অলাভ’ বলা ।
” নিদ্রায় জীব নিজ স্বরূপে যায় অজ্ঞান আবরণ (থেকে)। যেখানে নিরাবরণ স্বরূপ প্রকাশ, সেখানে নিদ্রার প্রশ্ন নেই।”
“দেহ-সংযম, বাকসংযম তো অনেক সময় হয়, কিন্তু মনঃসংযম হয় কোথায়? এরই জন্য চাই সংকল্প, চাই সাধনা, চাই ধৈর্য, চাই একাগ্রতা।”
“কর্ম, ভক্তি, জ্ঞান একই (ব্যাপার)। যেমন ‘আমি স্বরূপ দেখবো।’— এই হলোজ্ঞান – (লক্ষ্য), ভক্তি হলো স্বরূপ দেখার আকর্ষণ, তারপর কী? না সাবান লাগাও আবার জ্ঞানগঙ্গায় ধুয়ে ফেলো-এই সব হলো কর্ম। সবই একের মধ্যে আছে।”
” ভগবদপ্রাপ্তি ইচ্ছায় কুণ্ডলিনী জাগরণের ক্রিয়াদি যেখানে হয়, সেখানে তিনি সাড়া দেন না— হতে পারে না; – বিশ্বাস যেন থাকে।”
“যার চোখে ভগবান সর্বময়, তার স্থান সর্বত্রই সুলভ।”
“শরীরটা কি নিজে তৈরী করেছো, যাঁর শরীর তাঁর স্বাধীন ইচ্ছা। (তিনি) যা হয় করুন না। — ইচ্ছাময়ের ইচ্ছাই যে পূর্ণ হচ্ছে সর্বক্ষণ। সৃষ্টির বিধানই যে এই। ….যা প্রয়োজন তিনি সময়মতো (ঠিক) করেন, এই বিশ্বাস রাখো। একটা তৃণ ওঠাবার শক্তি কারো নেই, সেই ইচ্ছাময়ের ইচ্ছাই পূর্ণ হয়। সাময়িক কষ্ট হলেও মঙ্গলময় মঙ্গল করেন। সাধারণ (বদ্ধ) জীবের পক্ষে তা বোঝা কঠিন।”
“গুরু বলতে প্রকৃতপক্ষে ভগবানকেই বুঝি। তিনি সর্বত্রই আছেন। এবং সকল সময়েই আছেন।”
” জীব স্বভাবতঃই আনন্দ চায়। তার ভেতরে এই “আনন্দ” আছে বলেই তো তা চাইতে পারে। তা না হলে সে তা চাইতো না। সে আনন্দ না চেয়ে থাকতে পারে না। লক্ষ্য করলে এই আনন্দের আকাঙ্খা সমস্ত জীবের মধ্যে দেখতে পারে। মানুষও সেইরূপ ত্রিতাপের জ্বালায় তাপিত হয়ে শান্তির স্থল আনন্দের আকর শ্রীভগবানকে খোঁজে।”
” ‘কিছুই ছাড়বো না, অথচ সকলই পাবো।’ এ কখনো হয় না। কারণ একসময়ে একই স্থানে দুই বস্তুর স্থিতি হতে পারে না এবং ত্যাগ ব্যতীত কোনো কর্মই চলে না ৷”
“ভগবান, সাকার, নিরাকার দুই-ই। তিনি আপন খেয়ালের আনন্দে থাকেন। সমস্ত ক্রিয়া তো তাঁরই।”
” যতক্ষণ ‘আমি আমার’ ততক্ষণ ভগবৎ বোধ নেই।”
” ‘তিনিই সব আর কিছুই নেই,’ (এই বোধ হয়ে গেলে, সাধকের) তাই কোনো কথায়, কোনো ব্যবহারেই বাধা আসে না। (সমত্বসূচক সাক্ষীত্বে) একই ভাব সর্বদা ৷”
“বাধা-বিঘ্ন তো সাধকের পক্ষে অত্যন্ত দরকার, কারণ তার ফলে অনেক তত্ত্বপ্রকাশ হয়, অর্থাৎ সাধক অগ্রসর হয়ে যেতে সুবিধা পায়।”
” মোহতে লোক ঘেঁসে যায়, মোহগ্রস্ত হয়ে যায়; মোহ অজগরের মতো গ্রাস করে নেয়। বাসনার বীজই আসা যাওয়ার মূল।”
” ভগবান পরমবস্তু। —ভরসা যা কিছু তিনিই। সঙ্গেই তিনি রয়েছেন। তিনি সর্বরূপে বর্তমান।”
” সকলেই যার যার নির্দিষ্ট কর্মপথে বিশ্বপিতার ইচ্ছা সম্পন্ন করে উন্নতির দিকে ক্রমে অগ্রসর হচ্ছে। কাজেই গুণ বা অবস্থাদির কথা মনে করে নিজে বড় ও অন্যে ছোট এরূপ মনে করাই ভুল। বিরাট জগৎটিকে খণ্ড খণ্ড ভাবে না দেখে সমষ্টিরূপে দেখো, তাহলে এ সম্বন্ধে আর কোন সন্দেহই স্থান পাবে না।
“কেবলই তত্ত্ব নিয়ে বসে থাকলে চলবে না; তদনুযায়ী কর্মও অভ্যাস করা চাই। অভ্যাসেই সব হয়ে থাকে।”
“সবই অনন্ত, তিনিই সব রূপেতে কিনা । …অন্তের মধ্যে অনন্ত, অনন্তের মধ্যে অন্ত, সবই যে আছে।”
“যে অবস্থাটা ‘বাক্য-মনের অগোচর’ বলে বলা হয়, …যে অবস্থাকে ‘যা, তা-ই’ বলি অথবা ‘নিজেকে ফিরে পাওয়া’ বলি, এটিকে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের বাইরের অবস্থা বলা যেতে পারে। এই অবস্থায় পৌঁছলে বোঝা যায় যে, যে যে অবস্থায় দাঁড়িয়ে যা বলছে, ওই অবস্থায় তার পক্ষে ওইরূপ বলাই স্বাভাবিক। এই-ই নির্দ্বন্দ্ব অবস্থা। (তখন বোঝা যায়) যা হওয়ার তা-ই হয়ে যাচ্ছে। যা আছে, তা-ই আছে; যা কিছু হয়ে যায় তা-ই ঠিক।”
“সাধনে অহং-ভাব ও কর্ম আছে ; সমাধিতে এ দুয়েরই সমাধান – যেখানে গিয়ে কর্ম, কর্মের ইচ্ছা, কর্মের ভাব, ইচ্ছা-অনিচ্ছা সমাপ্ত হয়ে যায়, তা-ই সমাধি।”
” ভাষার মধ্যে আনন্দেই তাঁর খণ্ডিত রূপই প্রকাশিত হয়। – কথাতে প্রকাশ করা যায় না।”
“তিনি অনন্তভাবে, অনন্তরূপে অনন্তলীলার খেলা খেলছেন, বহু না হলে এ খেলা কী করে চলে? দেখো না, আলো ও আঁধার, সুখ ও দুঃখ, আগুন ও জল কেমন করে একই শৃঙ্খলে বাঁধা রয়েছে।”
” ‘অহং’ বুদ্ধি দ্বারা লেখাপড়া কাজ-কর্ম সব কিছু করছে …আর ধর্ম—কাজের কথা হলেই ‘তিনি না করলে কী করে করবো।’—এই কথা বলা চলে না।”
” বাস্তবিক তুমি তো তাঁকে ডাকো না, তিনিই সর্বদা তোমাকে ডাকছেন।”
“এই যেমন ‘, ‘আমি’ দুইজন, আবার ‘তুমি’ ‘আমি’ একই। এই যে দুজনের মধ্যে শূন্য আছে, এও কিন্তু ‘আমি’-ই।”
“নিজেকে সমগ্রভাবে পেলেই বলা যায় যে, ‘সকল পথই আমার পথ।’ নিজেকে পাওয়ার অর্থ ভগবানকে পাওয়া আর ভগবানকে পাওয়ার অর্থ নিজেকে পাওয়া । – সমস্তই তো ভগবানের, তাই (আসলে) নিজেকে নিয়েই নিজের লীলা।”
” ‘খুব ভগবানের নাম’করো। সব পাপ-তাপ জ্বলে যায়। ভগবন্নাম ভগবানেরই তো বিগ্রহ। নামের সঙ্গে ভগবন্নামের প্রভাবে তত্ত্বপ্রকাশ হয়ে যাবে।”
” বাসনার বীজই আসা-যাওয়ার মূল। যে বন্ধনে আছে, সে-ই জীব, আর যা গতিমান তা-ই জগৎ। জীব আর জগৎ মনের খেলা। মনকে শুদ্ধ ভোজন দিলে নিজের যে স্বাভাবিক গতি আছে, নিজের যে যথার্থ স্বরূপ, অর্থাৎ আপনাতে যে আপনি তার প্রকাশ হবে ।”
“ভগবান নিজেই জীব হয়েছেন। যতক্ষণ বন্ধনের জ্ঞান আছে, বুদ্ধি আছে ততক্ষণ বন্ধন, এই (ভ্রান্ত) বুদ্ধি গেলেই কর্মবন্ধনও দূর হয়। ‘সবই তো ভগবানের ইচ্ছায় হচ্ছে’ – এই অনুভব করতে পারলেই মুক্তি।”