স্বামী তুরীয়ানন্দ ১৮৬৩ সালের জানুয়ারি মাসে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কলকাতা জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ইনি হরিনাথ চট্টোপাধ্যায় নামেও পরিচিত। ইনি স্বামী বিবেকানন্দের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন, এবং শ্রীরামকৃষ্ণের একজন বিশেষ শীর্ষ ছিলেন। ইনি অদ্বৈত বেদান্তে বিশ্বাসী একজন সন্ন্যাসী ছিলেন। অবশেষে শারীরিক অসুস্থতার কারণে ইনি ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যে মারা যান। তবে এনার কিছু উপদেশ নীচে উল্লেখ করা হলো।
“মনুষ্যদেহ ধারণের উদ্দেশ্য—জীবন্মুক্তি সুখপ্রাপ্তি। … সাধন ভজন আর কী? একটা জিনিস রয়েছে, তার সঙ্গে নিজেকে একাত্মতায় সচেতন করে দেওয়া। দুটো তো নেই, একটাই রয়েছে।….তাঁর দিকে যতই এগিয়ে যাবে ততই শান্তি। শেষে তাঁতেই ‘বিশ্রাম’ করতে হবে। তুমি কি আর আলাদা? … তাঁর থেকে আলাদাবোধে ইচ্ছার স্বাতন্ত্র্য কখনই নেই … স্বাধীনতা এক আছে, তাঁর সঙ্গে একবোধে।”
“মানব সৃষ্টির দুটো মতবাদ। একটা হচ্ছে চুরাশি লক্ষ ‘প্রজাতি’ ভ্রমণ করে তবে মনুষ্যজন্ম পাওয়া যায়। আর একটা হচ্ছে ভগবান থেকে নেমে আসা…..। অ্যামিবা থেকে মানুষ হওয়া পর্যন্ত ‘যোগ্যতমের ঊর্দ্ধতন’ মতবাদ সত্য বটে, কেননা (ওই পর্যন্ত বিবর্তনে) এতদিন স্বার্থটাই ছিল প্রধান লক্ষ্য, কিন্তু “মানুষ” হওয়ার পর আর একটি মতবাদ হয় যে, তখন লক্ষ্য ভগবান, তখন স্বার্থকে যে যত ভুলতে পারবে, সে তত তাঁর দিকে এগোবে।”
“‘আমি নই, তিনি কর্তা’ এই বোধে পাশ ছিন্ন হয়। …. ‘আমি কর্তা’ বোধ ভ্রান্তিমাত্র। ‘কে আমি’… বিচার করলে ঠিক ঠিক ‘আমি’ তাতেই পর্যবসিত হয়। দেহ- মন-বুদ্ধি এ সকলে ‘আমি’ বোধ অবিদ্যা কল্পিত ভ্রান্তি মাত্র….(বিচারে) সব চলে যায় থাকে মাত্র এক সত্তা।….সেই সত্তাই অখণ্ড সচ্চিদানন্দ ব্রহ্ম ‘অহং’ প্রত্যয় সাক্ষী আবার সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়কারী অথচ বিভু। তাঁকে আশ্রয় করে এই জগত্যন্ত্র তাঁর শক্তির দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। লীলাময় তাঁর লীলা দেখছেন ও আনন্দ করেছন। যাকে তিনি বোঝাচ্ছেন যে বুঝছে, অন্যে নিজেকে তাঁর থেকে ভিন্ন ভেবে মুগ্ধ হচ্ছে। এই তাঁর মায়া। তাঁর শরণাগত হয়ে কর্ম করলে এই মায়া অপগত হয়। (তথাকথিত) ‘কর্তা’ বোঝে সে (আসলে) ‘কর্তা নয়, যন্ত্রমাত্র, (এই বোধে কাজ করা) এর নাম ‘করেও না করা’। এটিই অকর্তানুভূতি। এটিই জীবন্মুক্তি। এই জীবন্মুক্তি সুখ ভোগ করার জন্যই আত্মার দেহধারণ। ….এই দেহ থাকতেই ‘অদেহবোধ’ লাভ করাই মনুষ্য জীবনের চরম উদ্দেশ্য।”
“এলিয়ে পড়াটা না বিজ্ঞানীর ভাব না ভক্তের ভাব। ওটা ভোগীর ভাব। নিজের পায়ে দাঁড়ানো মানে তাঁকে নিয়ে যে ‘আমি’, সেই ‘আমি’-তে দাঁড়ানো, তা না হলে আমি ‘অমুক’, ‘এই পাস’, ওই পাস’ এতে দাঁড়ানো কিছু নয় । … সবেতেই ‘আমি’ ভুলতে হবে।…এই যে পা ফেলছি এও তাঁর শক্তিতে।”
“এটা পাকা করে জানতে হবে যে ‘তাঁর ইচ্ছায় সব হচ্ছে। আর তাঁর ইচ্ছায় সব যাচ্ছে, ….বাসনাশূন্য হওয়ার পর তাঁর ইচ্ছায় আবার কাজ করা যায়। সাধনা দ্বারা তত্ত্ব-নিশ্চয় হলে…..সকল সন্দেহের অবসান হয়ে যায়। তারই নাম শান্তি বা ‘বিশ্রান্তি’ লাভ। ভগবৎ কৃপায় যার হয় সে-ই জানতে পারে। নচেৎ প্রশ্ন করে কোনোকালে সে অবস্থা লাভ হয় না। শুধু বিচারে কিছু হয় না।”
“একগুঁয়েমি দুর্বলতার একটা আবরণ…..প্রকৃত শক্তি সবদিকে যাবে, সবদিকে নুইবে, আবার নিজের শক্তিতে ফিরবে।”
“আহার, নিদ্রা, ভয়, মৈথুন—এই চারটিতে মানুষ পশুর সমান। জ্ঞানেতেই মানুষ ভালোমন্দ বিচার করতে পারে। জীবন যতো উন্নত হবে ততো দর্শন-জ্ঞানে সূক্ষ্ম আনন্দ। নিম্নস্তরের (চেতনার) লোকেরা এসব বুঝতে পারে না।…একেবারে পশুর মতন।….মানুষ জীবন পেয়ে বৃত্তিকে (পশুর থেকে) আরও উঁচু না করলে কী হলো ?”
“যাদের বিচারবোধ নেই তারা শীঘ্র একদিকে পক্ষপাতী হয়ে পড়ে, একতরফা শুনেই। মনকে খুব বিশ্লেষণ করতে হয়, তন্ন-তন্ন করে দেখতে হয়। যতো তাঁকে চিন্তা করবে, ততো তিনি তোমার মধ্যে বেড়ে উঠবেন, আর তোমার খারাপ ভাবটা পালিয়ে যাবে, ততো সরল উদার হবে।…..নিজে কিছু না করলে কারো সাধ্য নেই যে তাকে কিছু করে দিতে পারে……মহাপুরুষেরা রাস্তা দেখিয়ে দেন।”
“তাঁর কাছে ভক্তি প্রার্থনা করবে। আর তিনি যা করাবেন, তার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। প্রার্থনা করবে, ‘প্রভু’, এমন কাজ দিও না যাতে তোমায় ভুলে যাই। যেখানেই রাখো, তোমায় যেন মনে থাকে।’ তবে বোলো না, ‘আমায় এই দাও, ওই দিও না । আসল কথা যেমন করেই হোক, তাঁকে ভালোবেসে আপনার করে ফেলা।…ভক্তি যদি হলো তবে আর কী চাই?”
“জিহ্বা আর উপস্থ, প্রবল ইন্দ্রিয়।….উভয়ের মধ্যে জিহ্বা প্রধান, জিহ্বা জয় হলে কামও জিত হয়। ইন্দ্রিয়সংযম না হলে কিছুই হবার যো নেই।…কামের ভেতর একটা মনস্তত্ত্ব আছে, এক হয়ে যাবার ইচ্ছা। এটাও প্রেমের একটা প্রকাশ বিশেষ। তবে মানুষ স্থূল থেকে আরম্ভ করে বলে এটাকে শুদ্ধ বস্তুতে নিয়ে যেতে পারে না। কারো কারো কিন্তু এ থেকেও হয়েছে। প্রেম ও কাম পাশাপাশি ৷ ভগবদ্বদ্ধি থাকলেও প্রেম।”
“তিনিই এক অনাদি। আর কিছু অনাদি আছে কি? লোককে বোঝাবার জন্য ওসব বলতে হয় যে, কর্ম অনাদি ইত্যাদি। সুখ অসুখ সব তাঁর ইচ্ছায় হচ্ছে, যাচ্ছে- এই হলো সিদ্ধান্ত। তিনি যাকে বোঝান সেই বোঝে।”
“অদ্বৈতভাব আনবার জন্যেই দ্বৈতভাবের উপাসনা। ঈশ্বরের সঙ্গে সম্বন্ধটা পূৰ্ণভাবে করতে পারলেই দ্বৈত আপনা থেকে চলে যাবে; থাকবেন কেবল পরমাত্মা।”
“যদি আত্মার স্বরূপ নিশ্চয় করতে পারো। তা হলে মনের নানা প্রকার ভাবতরঙ্গ থাকতেও তা থেকে আলাদা থাকতে পারবে সাক্ষীত্বে।”
“সমাধিতে মনোনাশ হয়। মনের নাশ মানে হচ্ছে বুদ্ধি বোধের পূর্ণ বিকাশ। মন যে একেবারে নষ্ট হয় তা নয়। ব্যবহারিক জগতে, শুদ্ধ মনে ‘এক’ আত্মাতে নিশ্চয়বান হয়ে, সকলের মধ্যে এক আত্মাকে লক্ষ্য করে ব্যবহার করার নামই মনোনাশ।”
“অবিদ্যানাশ হলেই সংসার (বন্ধন) নাশ হলো, কিন্তু নির্বাণে মূল প্রকৃতি বন্ধনই নাশ হয়ে যায়। যে সমাধিতে দৃশ্য, দ্রষ্টা ও দর্শন লয় হয়, তাতেও মূল প্রকৃতি পর্যন্ত চলে যায়। জ্ঞানলাভের পরে দেহনাশ হওয়াই নির্বাণ বিদেহমুক্তি মুক্তি তো রয়েইছে। আত্মার তো বন্ধন হয়নি, তবে সেটি জানা চাই।”