Life quotes in Bengali by Swami Rama Tirtha | স্বামী রামতীর্থের ৩০টি জীবনমূলক বাণী

শ্রীমৎ স্বামী রামতীর্থ ১৮৭৩ সালের অক্টোবর মাসে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাবের এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ইনি একজন গণিতের শিক্ষক হিসেবে। পরবর্তীতে ১৮৯৯ সালে ইনি সন্ন্যাস জীবন গ্রহণ করেছিলেন। তিনি একদিকে সমাজ সংস্কারক ছিলেন, তাই তিনি সমাজের বর্ণভেদ প্রথা এবং নারী ও শিশুদের শিক্ষার কথা বলতেন। অবশেষে ইনি ১৯০৬ সালের অক্টোবর মাসে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের যুক্ত প্রদেশের (বর্তমানে উত্তরপ্রদেশ ) শেষ জীবন ত্যাগ করেছিলেন। –

Life quotes in Bengali by Swami Rama Tirtha
Photo by pexels.com

“আত্মনির্ভরতা ও আত্মপ্রত্যয়ই সাফল্যের মূল সূত্র। …. তোমার অন্তর থাকুক অচঞ্চল আর শরীর থাকুক সদা কর্মরত। তোমার দেহক্রিয়া থাকুক ‘গতিবিদ্যার’ সূত্র ধরে, আর আত্মবোধ থাকুক ‘স্থিতিবিদ্যা’র স্থিরতায়। …আমাদের স্বার্থবদ্ধ চেতনার অস্থিরতায় সকল কাজের হানি ঘটায়।”

“তোমার সমস্ত ক্রিয়ায় প্রকৃতপক্ষে তুমি সাক্ষীমাত্র, ফলাফল যাই হোক, তোমার অস্তিত্বে তাতে কোনো বিক্রিয়া হয় না। এই সাক্ষীস্বরূপ চৈতন্যবোধক ধারণাসহ কিছুক্ষণের জন্য চোখ বন্ধ করে, শিথিল শরীরে সমস্ত চিন্তা সরিয়ে দিয়ে মুক্তচিত্তে থাকার চেষ্টা করবে। এইভাবে যতই (মেঘমুক্ত আকাশের মতো) অহংদায়মুক্ত চেতনায় অথচ নিষ্ঠাভাবে কাজ করবে, ততই তুমি শক্তিময় বোধিতে জাগ্রত হবে।”

“ধর্মের মূল লক্ষ্য হলো বাক্য-মনের আগোচর অদ্বিতীয় সেই সত্তার অবর্ণনীয় উপলব্ধি, যার মাঝে দেহ-মন, স্থান-কাল সমেত যা কিছু সব তথা এই জগৎ তার সত্তা হারিয়ে লীন হয়ে যায়। এই উপলব্ধির জন্য গড়ে তোলা পথই ধৰ্ম। বস্তুতঃ সকল ধর্মমতই আসলে আমাদের সত্য-স্বরূপকে উন্মোচিত করার এক একটি বিশিষ্ট প্রয়াস পন্থা ও ব্যাখ্যার আধার। ….প্রতিটি ধর্মেরই নিজস্ব দর্শন, পৌরাণিক আখ্যান ও পালনীয় আচার আছে। জ্ঞানীদের জন্য দর্শন, ভাব-প্রবণদের জন্য আখ্যান ও বাকি সাধারণের জন্য বিশেভাবে আছে বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান।”

“অপরকে ছাড়িয়ে যত খুশী মাথা তুলে দাঁড়াতে চাও দাঁড়াও, কিন্তু তোমার পা যেন অন্যদের সঙ্গে একই ভূমিতে থাকে। তোমার পা যেন অপরের বিশেষতঃ দুর্বল অসহায়ের ঘাড়ে চেপে না থাকে। ……ভ্রাতৃত্ববোধে জাগতে হবে, সবাইকে  দিতে হবে শ্রমের মর্যাদা।”

“যদি চেতনার উত্তরণ পেতে চাও, বহমান নদীর মত সচল হও। নদী যেমন বহু রকম স্থানের মধ্য দিয়ে, সকল পরিবেশের সঙ্গে ঐকতানে এগিয়ে চলে, তোমার কর্মক্ষেত্রে তেমন হয়ে ওঠো। ….নিষ্ক্রিয়তা মানুষকে পতনের দিকে নিয়ে যায়, আর শুভ সক্রিয়তা নেয় উন্নতিশীল রূপান্তরের পথে।”

“কর্মযজ্ঞে সাফল্যের মূল পাথেয় হলো ভালোবাসা; জগৎ প্রবাহের সঙ্গে ছন্দময় ঐক্যবোধ, পরিবেশের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন। ভালোবাসা অর্থাৎ প্রতিবেশীদের সঙ্গে নিজের স্বরূপগত একত্বকে মনে রেখে ব্যবহার করা।”

“মানুষের স্বরূপ বা আত্মা স্বচ্ছ হীরক বা স্ফটিকের মতো। স্ফটিকের সান্নিধ্যে যেমন রঙ-এর সমাহার হলে তাতে সেই রঙটিই প্রতিফলিত হয়, কিন্তু স্ফটিকটিকে আপাতভাবে ওই রঙের বলে তখন মনে হলেও, তার স্বচ্ছতা আসলে পাল্টায় না, কারণ প্রকৃতই বর্ণহীন। তেমনই মানুষের স্বরূপ বিশুদ্ধ আত্মচৈতন্য মাত্র। তোমার মধ্যে যে আত্মা, সবার মধ্যেই এক তিনিই। সেই ব্যাপ্তিস্বরূপ অন্তর্যামীর সঙ্গে অভিন্নতাবোধে জাগ্রত হও আপন আত্মবোধে।”

“সত্যিকারে স্বাধীনতা হলো, সঠিক প্রয়োজনবোধ অনুযায়ী চলতে পারা। তাই প্রকৃতপক্ষে প্রয়োজন হলো সত্যস্বরূপ আত্মবোধের উপলব্ধির, যার ফলে জীবন চেতনা অহংবদ্ধতা থেকে মুক্তি পেয়ে “স্বাধীন আত্মবোধে” জাগ্রত হতে পারে।”

“যে কাজই করতে হোক, উদ্বেগ ও অতিব্যস্ততাকে কিংবা শঙ্কা ও উৎকণ্ঠাকে একদম প্রশ্রয় দেবে না। সে কাজ করতে যখন হবেই তখন প্রসন্নচিত্তে উৎসাহের সঙ্গেই করবে। সত্যিকারের প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য শুধু ঠিক কাজটা করাই নয়, কাজটাকে ঠিকভাবে করাও বটে।”

“জগতের সবই সর্বদা প্রবহমান। কিন্তু প্রতি জীবের মধ্যে রয়েছে এক অপরিবর্তনীয় নিশ্চল সত্তা। (ব্রহ্মশক্তির) মায়াপ্রভাবে অজ্ঞানতায় জীবগতভাবে সেই সত্তায় দেহের পরিবর্তনশীলতা আরোপিত হয়। একবার এই অজ্ঞানতা দূর হয়ে গেলেই জীব তার নির্বিকার শুদ্ধ স্বরূপবোধে সজাগ হয়ে যায়। বস্তুতঃ বিকারশীল এই দেহ জীবের আত্মা তো নয়। প্রতি জীবে বিরাজমান অধিকারী সত্তাই জীবের মুক্তি আত্মা, অমৃতস্বরূপ পরমাত্মা ।

“প্রার্থনার তাৎপর্য ঘটে ভাগবানের ইচ্ছা ও মানুষের ইচ্ছার মিলনের মধ্য দিয়ে। …..সাধারণ মানুষ নিজ সংস্কারে মনে করে যে তার প্রার্থিত ইচ্ছাটির অনুযায়ী ভগবান নিজের ইচ্ছা পরিবর্তিত করে সাড়া দেবেন। আর এর বিপরীতে আধ্যাত্মিক মনন-ñ-সমৃদ্ধ চেতনার গভীরে মানুষ মনে করে যে, প্রার্থনার মধ্য দিয়ে মানুষের ইচ্ছাই শোধিত হয়ে পরিবর্তিত হবে। ….কিন্তু কেন বাইরে থেকে  কিছু প্রাপ্তির জন্য প্রার্থনা ñকরবো, যখন জানাই আছে, আমি সেই পরম জীবনের সঙ্গে অভিন্ন। তবে আমার প্রার্থনা হোক সেই প্রসন্নতার জন্যই যার ভিত্তি হলো পরমের সাথে অভেদবোধের উপলব্ধি ৷”

“চিরন্তন সত্যকে উপলব্ধি করতে হবে। পণ্ডিতের বক্তব্য হলেই ‘সত্য’ বলে মানলে চলবে না।”

Life quotes in Bengali by Swami Rama Tirtha

“তোমার আধ্যাত্মিক আদর্শ যেমন আনন্দস্বরূপে সচেতন থাকা, তেমনই তোমার আধিভৌতিক বা জাগতিক আদর্শ হলো সকলের সঙ্গে সৌহার্দ্যে থাকা।”

” জগতে কোনো ব্যাপারই মন্দ নয়, যদি না সেটি মনুষ্যত্বের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়; আবার জগতে কোনো জিনিসই ভালো নয়, যদি সেটি মানুষকে বশীভূত করে রাখে”

“দিতে শেখো, শুধু নিতে পারলেই হবে না। … বিলাসপ্রিয়তার মধ্যেই সুপ্ত থাকে অধঃপতনের অন্ধকার। … সবরকম শঙ্কার উৎসে থাকে স্বার্থপর চেতনা। … মানুষ কোনো বস্তুর দ্বারা মনে প্রভাবিত হয় না, সে প্রভাবিত হয় বস্তুটিকে ভোগ করার চিন্তার দ্বারা।” 

“কর্তব্যবোধে কাজ করে যাও। ভালো কাজ করতে পারাই কাজের পুরস্কার। অতীত নিয়ে অবসাদ বা ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ ত্যাগ করা; বর্তমানকে ধরে মন দিয়ে কাজ করে যাও।”

“প্রকৃতির ছন্দের ঐকতানে জগতের সর্বজীব ও বস্তুর সাথে অভিন্নবোধে জাগ্রত হলে তবেই চতুর্দিকে পরিবেশ ও ঘটনাপ্রবাহকে চিনতে পারা যায় শুভভাবাপন্ন গতিশীলরূপে। নচেৎ সবই থাকে দ্বন্দ্বময় বহুমাত্রিক ভিন্ন ভিন্ন নামরূপ নিয়ে গতানুগতিক জাগতিকভাবে।”

“নির্লোভ চেতনায় অটল পর্বতের মত মনোভাব থেকে যা করার করে যাও, দেখবে যে কাজই আসুক তোমাকে তা ক্লান্ত করতে পারবে না। তবে কাজের মাঝে যখনই অবসর পাবে, মনন করবে যে শুধুমাত্র এক সত্যস্বরূপ ভগবানই আছেন, এবং তিনিই তোমার অপরিবর্তনীয় আত্মস্বরূপ।”

“বুদ্ধির বিচারে (দ্বন্দ্বাতীত) আত্মতত্ত্বটিকে স্বীকার করে নিয়ে জ্ঞানযোগী যখন গভীরতম অনুভবে প্রকৃত আত্মচৈতন্যবোধে জাগে, তখনই সে আপন বোধে লাভ করে আত্মানন্দ এবং ইহলোকেই জীবমুক্ত হয়ে যায়।”

“সকলের মধ্যে কার্যশীল আছে শুধুমাত্র একটি শক্তিই। সেই পরমাশক্তিতেই সমস্ত ক্রিয়া সাধিত হয়। সেইটিই ব্রহ্মশক্তি।”

“যখন তুমি উপলব্ধি করবে যে আসলে তুমি (তোমার মাধ্যমে কৃত-কর্মের) ‘অকর্তা’, তখনই তুমি হয়ে উঠবে জগতের শ্রেষ্ঠ স্তরের কর্মী।”

“প্রয়োজন হলো স্বতঃস্ফূর্ত প্রয়াসী ধর্মাকাঙ্ক্ষীর, যারা বস্তুবাদের অন্ধকার জঙ্গলের মধ্য দিয়ে সূর্যালোকবৎ প্রজ্ঞার প্রবেশ পথ তৈরী করে দেবে।”

“জাত-বিচার বা সম্প্রদায় নির্ণয় দরকার নেই, প্রয়োজন শুধু সহানুভূতিশীল কর্মধারা; শ্রেণীবিচার বা দল নির্ণয়েও লাভ নেই, বাঞ্ছিত শুধু মনুষ্যত্বের বোধ; চাই শুধু সুস্থ মস্তিষ্ক ও পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা …যার দ্বারা উপলব্ধি হয় অবিভাজ্য মানবিকতা ও অদ্বিতীয় ভগবত্তত্ত্ব।”

“জগৎরূপ এই লীলা-নাটকে আমাদের যথার্থভাবে অংশগ্রহণ করতে হবে। ভুললে চলবে না যে সবটাই (অদ্বৈত স্বরূপের মাঝে দ্বৈতবোধক নাম-রূপের সাজে) অভিনয়।”

“যে অপরের সম্পত্তি হরণ করে সে চোর, আর যিনি অপরের ‘অহং-কর্তা’-বোধ কেড়ে নেন তিনি সদ্‌গুরু।”

Life quotes in Bengali by Swami Rama Tirtha

“তোমার সক্রিয়তা যতই অহংবদ্ধতা কাটিয়ে উঠবে এবং তুমি ‘আমি কাজ করি’ …..বোধকে ছাড়িয়ে কর্তৃত্ববোধ, সুযোগসন্ধানী সুবিধাবাদী ভাবমুক্ত হয়ে স্থিরবোধে জাগতে থাকবে এবং নিজের অহং-স্বাতন্ত্র্যবোধকে অস্বীকার করে অগ্রগামী হবে, ততই তোমার মধ্য দিয়ে যথার্থ সক্রিয়তা সুসম্পন্ন হতে থাকবে।”

“সত্যিকারের ধর্মবোধ মানে ভগবানে বিশ্বাসই মাত্র নয়, তা হলো মনুষ্যত্বের শুভ মূল্যবোধে আস্থার প্রকৃত সূচক।”

“ভক্তিযোগের সাধন পথে, প্রথম স্তরে ভক্ত বলে “আমি তাঁর”। ভগবানকে সে অনেক ব্যবধানে অবস্থিত অদৃশ্য পৃথক একটি সত্তারূপে মনে করে। পরের স্তরটি খুব মধুর। সেই স্তরে ভক্ত বলে ‘আমি তোমার; আমি সর্বদা তোমাকে আশ্রয় করে থাকতে চাই’ যেন ভক্ত ও ভগবান মুখোমুখি। তারও পরের স্তরটিতে ভক্ত ও ভগবানের মিলনে সাযুজ্য ঘটে। সেই চরম স্তরে ভক্ত বলে, ‘আমি তুমিই’, প্রেমিক ও প্রেমাস্পদ এক হয়ে যায় ৷”

“তখনই তুমি পূর্ণতা ও অখণ্ডতা লাভ করো, যখন তুমি উপলব্ধি করো এই জগতের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য অভিন্নতা, –এই অদ্বৈতানুভবই বেদান্তের শিক্ষা।”

“মানুষ স্বরূপতঃই পরমাত্মা, নতুন করে তার হওয়ার কিছু নেই, শুধু প্রয়োজন উপলব্ধির। তারই জন্য যা কিছু সাধন অভ্যাসের ব্যবস্থাপনা। নির্ভয়, দৃঢ়চিত্ত হও।”

Leave a Reply