শ্রীমৎ স্বামী ভারতীকৃষ্ণ তীর্থব ১৮৮৪ সালের মার্চ মাসে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ইনি ভেঙ্কটারমন শাস্ত্রী নামেও পরিচিতি ছিলেন। তিনি গণিত, বিজ্ঞান, দর্শন , সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস সহ বিভিন্ন বিষয়ে পান্ডিত্য লাভ করেছিলেন। ইনি বৈদিক গণিতের কিছু সূত্র আবিষ্কার করেছিলেন। পরবর্তীকালে ১৯১৯ সালে তিনি সন্ন্যাসী জীবন গ্রহণ করেছিলেন। অবশেষে ইনি ১৯৬০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শেষ জীবন। এনার কিছু উপদেশ নীচে উল্লেখ করা হলো।-
“বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের মতবাদ নিজ নিজ ক্ষেত্রে মঙ্গলপ্রদ ভূমিকায় যতদূর কার্যসাধক হবে, থাকবে; তারপর নানান প্রাচীন সভ্যতার মত বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কিন্তু এই জগৎ লয় না হওয়া পর্যন্ত সনাতন ধর্মের সক্রিয়তা বন্ধ হতে পারে না; আবার নতুন কল্পের জগৎ সৃষ্ট হলেই সনাতন ধর্মেরও প্রকাশ ঘটবে, ভাগবতী স্বাভাবিক নিয়মেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে— জীবচেতনার উত্তরণে যথাযথ সহায়তাকারী ভূমিকা নিয়ে।”
“আধ্যাত্মিক সংজ্ঞায় ‘সত্য’ হলো তা-ই যা নিত্য বিদ্যমান, অপরিবর্তনীয়, অক্ষয়, সনাতন। সেই জন্যই তা ‘সৎ’ পদবাদ্য। আর যা আদৌ নেই তা ‘অসত্য’ বা ‘অসৎ’। এছাড়াও তৃতীয় একটি প্রকাশ আছে যা “সত্য”ও নয়, ‘অসত্য’ ও নয়, তা ‘মিথ্যা’। এই মিথ্যা মানে যার কোনো নিজস্ব স্থায়ী অস্তিত্ব নেই, কিন্তু যা অনুভবে ধরা পড়ে, যা ইন্দ্রিয়গোচর হয়। – অর্থাৎ যা অপরিবর্তনীয় নিত্য নয় তার বাহ্যতঃ প্রকাশ থাকলেও তা ‘সত্য’ নয়। এই অর্থেই জগৎ ‘মিথ্যা’। জগৎ ব্রহ্মকে আশ্রয় করে প্রকাশিত, কিন্তু ব্রহ্ম জগৎকে আশ্রয় করে নয়। বস্তুতঃ এই জগৎ ব্রহ্মেরই লীলারূপ। তিনিই (আপন মায়ায়) জগৎরূপে লীলায়িত আবার জগৎ ছাড়িয়েও নিত্য বিদ্যমান।”
“বিশ্বশান্তির মাধ্যমে জগতের আভ্যুদায়িক উন্নতিসাধনই সামাজিক মানুষের শ্রেষ্ঠ আদর্শ। এইটি স্মরণে রেখে চলতে পারাই কাম্য। —বস্তুতঃ মানব-সমাজকে নিঃস্বার্থ সেবা না করতে পারলে ব্যক্তিগতভাবে ধর্মাচার পালনে দক্ষতার কোনোই মূল্য নেই।”
“অনিত্য বহুত্বের অন্তরালে যে নিত্য একত্ব, প্রকৃতপক্ষে তা-ই হলো জগতের সুপ্ত আশ্রয়, একটি বৃক্ষের মধ্যে আমরা দেখি মূল, গুঁড়ি, ফল, ফুল, পাতা আপাতভাবে আকারে, বর্ণে, স্বাদে, গুণে এবং সক্রিয়তায় আলাদা হলেও সবই তো সেই একই বৃক্ষের অভেদ অংশ এবং বৃক্ষটির প্রকাশশীলতায় পূর্বোক্ত প্রতিটি অঙ্গই নিজ নিজ স্ব-ভাবে কাজ করে যাচ্ছে বাকি সব কটি অঙ্গের সঙ্গে একত্রে। (সবই স্বগতভেদে থাকলেও আছে অদ্বৈত বৃক্ষেই)। এই জগতেও শাশ্বত একত্বটিকে আশ্রয় করে ঐক্যতানে সমাজজীবন পরিচালিত হওয়া কাম্য। বাইরে থেকে ‘সাম্য’ আরোপ করে কৃত্রিমভাবে স্থায়ী ব্যবস্থা কিছু হতে পারে না।”
“অদ্বিতীয় ব্রহ্ম জগদতীত হলেও জগৎ লীলায় তিনিই নানা নামরূপে অভিব্যক্ত হন। —এই নিত্য প্রবাহমান জীবজগৎ প্রকাশিত হয়েছে তাঁরই স্ব-ভাবশক্তির সংকল্পে।”
“আমরা যখন বিশ্বশান্তি ও মানবকল্যাণের কথা ভাবি, আমাদের মনে রাখা উচিত যে, এক ধর্মের সঙ্গে অন্য ধর্মের কোনো তত্ত্বগত কলহ নেই, ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে অন্তঃকলহ নেই। বুঝতে হবে যে, প্রকৃতপক্ষে সকল মানুষই একটি অখণ্ড জীবনপ্রবাহের অংশ। তাই সত্যের জ্ঞানদৃষ্টিতে কোনো মানুষকেই বিচ্ছিন্নভাবে দেখা সম্ভব নয়। সকলেই একের মধ্যে একেরই প্রকাশ তরঙ্গ। সনাতন ধর্ম মানে নিত্যসত্তার ধর্ম, স্বয়ং ভগবান প্রকাশিত ধর্ম, কোনো ব্যক্তিবিশেষের নির্দেশিত নয়। জগতের সকল ধর্মমতের প্রতিষ্ঠার আগেই সনাতন ধর্ম বর্তমান ছিল, আজও আছে, পরেও থাকবে।”
“গণিত, যন্ত্র-বিদ্যা, স্থাপত্য-বিদ্যা, চিকিৎসা-বিদ্যা আদি ‘অপরা-বিদ্যা’ সমূহ ‘পরা-বিদ্যা’ বা আধ্যাত্মিকতা থেকে বিযুক্ত নয়। জাগতিক বস্তুর মধ্য দিয়ে তো আত্মিক সত্তাই প্রকটিত। সুতরাং এই দুই বিদ্যাকে পুরোপুরি আলাদাভাবে চিহ্নিত তথা চর্চা করা অসম্ভব।”
“হৃদয়ের পবিত্রতার মধ্য দিয়েই আত্মোপলব্ধি ঘটে। সঠিক জ্ঞানের সহায়তায় মানুষ লাভ করে চেতনার উত্তরণ।”
“কোনো মানুষের দেহ, প্রাণ, মন, বুদ্ধি, হৃদয়, বিবেক বা যে কোনো আত্মিক বিষয়েই যা কিছু ঘাটতি থাক, সে আপন জীবনে মঙ্গল লাভের জন্য তার প্রয়োজনীয় উপদেশ-নির্দেশ অবশ্যই পেতে পারে, – সনাতন ধর্মের আলোকে। জীব (অহং স্বাতন্ত্র্যবোধক অজ্ঞানতায় বদ্ধ হয়ে, অহংবোধে কৃত) কর্মানুসারে বারংবার বিভিন্ন প্রজাতিতে জন্মগ্রহণ করে। (ক্রমবিকাশের পরিণতিতে লব্ধ) মানবজন্মে তার প্রধান কর্তব্য সত্যস্বরূপ ভগবানকে জানা এবং নিজের ও জগতের স্বরূপকে উপলব্ধি করা। এই স্বরূপই ব্ৰহ্ম।”
“সনাতন ধর্মের আশ্রয়ে প্রতিটি মানুষই আপন রুচি অনুযায়ী পন্থায় তার শাশ্বত স্বরূপবোধে জাগ্রত হওয়ার প্রেরণা খুঁজে পায় তথা এই ধর্মের বিশাল শাস্ত্রভাণ্ডার থেকে প্রত্যেকেই নিজ নিজ চেতনা ও সংস্কারের প্রয়োজনানুযায়ী উপদেশ-নির্দেশ লাভ করতে পারে; এবং পরিশেষে সচ্চিদানন্দস্বরূপ পরমাত্মার সঙ্গে সাযুজ্যবোধে জাগ্রত হতে পারে।”
“জীবের স্বরূপ কী? এটি নিত্য সত্তা “সৎ”, চৈতন্যসম্পন্ন ‘, সদাপ্রসন্ন ‘ তথা চিরস্বাধীন “মুক্ত” স্বরূপ। বস্তুতঃ জীবস্বরূপ এবং ব্রহ্মস্বরূপ এক অভিন্ন পরমাত্মাই।”
“সমস্ত ধর্মই সমতুল্য। প্রতিটিরই লক্ষ্য পরমসত্যের উপলব্ধি সাধন। সকল ধর্মের মধ্যে বিরাজমান ঐক্যটিকে অনুসন্ধান আমাদের কর্তব্য।”
“ব্রহ্মের (অখণ্ড) অব্যক্ত দশাই “নির্গুণ” পদবাচ্য এবং ব্যক্ত বা লীলাময় দশাই ‘স্বগুণ’ পদবাচ্য।”
“মানুষেরা যদি তাদের মূলগত জীবনছন্দ ও পারস্পরিক নির্ভরতার সূত্রটিকে চিনতে পারে, তাহলেই সেটির আশ্রয়ে জগতের মানবিক বৈষম্য ও বিপত্তিগুলির উৎসটিকে নির্মূল করা যেতে পারে। (আদর্শ হিসেবে) এই সত্যটিকে ঠিক মতো ধরে থাকতে সক্ষম হলে মানুষ নিজের মধ্যেই খুঁজে পাবে প্রজ্ঞার কেন্দ্রটি যার প্রভাবে মানবজীবনের দুর্দশাগুলি অবশ্যই দূরীভূত হবে।”
“যা সত্য, যা যুক্তিযুক্ত এবং মননসিদ্ধ বৈজ্ঞানিক কিংবা দার্শনিক মত তা বিষয়গত স্তরানুযায়ী স্বীকার করতেই হবে। সে তত্ত্ব যদি কোনো বালকও প্রকাশ করে তা গ্রহণীয়, কিন্তু যদি কোনো মতামত অযৌক্তিক বিজ্ঞানবিরুদ্ধ অসত্য হয় তা পণ্ডিতলোক বললেও ত্যজ্য।”
“জীবের দেহ নিয়ন্ত্রিত হয় ইন্দ্রিয় দ্বারা। ইন্দ্রিয়গুলি নিয়ন্ত্রিত হয় মনের দ্বারা, মনের ওপরে আছে বুদ্ধি। বুদ্ধিও “আত্মা” নয়। দেহ ও মনের মত বুদ্ধিও একটি ব্যবহারিক সত্তা (শক্তি)। বুদ্ধিরও অতীতে আছে আত্মা ৷”