শ্রীমৎ বালানন্দ ব্রহ্মচারী ভারতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ইনার ছোটবেলা থেকেই সংসারের প্রতি খুব একটা আগ্রহ ছিল না। বাল্যকাল ও বয়ঃসন্ধিকালে বেশিরভাগ সময় ইনি আশেপাশের সাধু-সন্ন্যাসীদের সঙ্গে সময় কাটাতেন। অবশেষে ইনি ব্রহ্মচারী গ্রহন করেছিলেন। ইনার কিছু অমৃত বাণী বাংলায় (quotes in bengali) নিচে উল্লেখ করা হলো। –
“অপরের দোষ না দেখে গুণ দেখা, এবং নিজের গুণ না দেখে দোষ দেখা ও সেই দোষ দূর করতে যত্নবান হওয়া উন্নত জীবন লাভের সুন্দর, সহজ ও সরল উপায়।”
“পরম সত্তা আমাদের মা।… মা তো কোলে নিতে চান, কিন্তু অবাধ্য সন্তান উঠতে চাই না, বিষয় রূপ কাদায় শুয়ে পড়ে। তখন মা ওই কাদার মধ্যেই তাকে আরো বেশি করে ডুবিয়ে দেন, এবং রোগ-শোক-দুঃখ-বেদনার মতো দু-চার চড়-চাপড়ও মারেন। তখন সেই সন্তান জব্দ হয়ে মায়ের পিছু নেয় এবং মা তখন সেই বিশ্বরূপ কাদা জ্ঞান-ভক্তিরূপ জলে ধুয়ে মুছে তাকে পরিষ্কার করে কোলে তুলে নেন।”
“সমুদ্র আর তরঙ্গ অভেদ, তরঙ্গ ক্ষণবিধ্বংসী বলে তাকে মিথ্যা বলা যায় না। সত্য সমুদ্রেই সেই তরঙ্গের স্থিতি, তাই ক্ষণস্থায়ী তরঙ্গ সত্য। সমুদ্র ও তরঙ্গ অভেদ হলেও ‘সমুদ্রের তরঙ্গ’ বলা হয়, কিন্তু ‘তরঙ্গের সমুদ্র’ বলা হয় না। তেমনি এই জীবজগৎও সেই ব্রহ্ম সমুদ্রেরই তরঙ্গ – তার সত্তা নিজেই জগত ভাসমান।
“সময় সময় জ্ঞানীদেরও যে বিক্ষেপভাবাপণ্য দেখা যায়, তা দেহাত্মবাদীদের মত নয় । তাই একটা অহংভাববর্জিত শারীরিক ধর্মমাত্র..। সাক্ষীবধে থাকায় তাদের স্বার্থ বলে কিছু মাত্র ভাব থাকে না।”
“গুরু প্রদত্ত ” মন্ত্রকে রোজ ” বারি’ দিয়ে সিঞ্চন করতে হবে। বীজটিকে পচিয়ে ফেললে চলবে না।-তারপর যখন অঙ্কুর জন্মায়, সেটিকে তখন নামমাত্র বেড়া দিতে হয়, তাহলে আর ইন্দ্রিয়রূপী জানোয়াররা তাকে খেতে পারে না। যখন ধীরে ধীরে সেই অঙ্কুর পুষ্ট হবে, হঠাৎ শিষ্য যখন ধর্মে প্রতিষ্ঠিত হবে, তখন ইন্দ্রিয়াদি পশুগুলি সেই গাছের গুড়িতে সহজেই বাঁধা থাকতে পারবে।… শিষ্য তখন একদম নিশ্চিত হয়ে নির্ভয়ে সেই ধর্ম বৃক্ষের ছায়ায় জীবন কাটাতে পারবে।”
“অস্তি, ভাতি, প্রিয় এবং নাম ও রূপ এই পাঁচটি নিয়ে অখন্ড জগৎ। এর দুটি অংশ। একটি ‘ব্রহ্ম’ এবং অপরটি ‘জগৎ’। স্বর্ণালংকার বললে যেমন অলংকারটির মুলি স্বর্ণ ছাড়া অন্য কিছু নয়, এটি বোঝা যায়। তেমনি এই জগতের মূলে যে ব্রহ্মা ছাড়া অন্য কিছু নয়, তাও বোঝা যায়।… যেমন স্বর্ণ থেকে অলংকারের নাম ও রুপ পৃথক আছে। তেমনি ব্রহ্ম থেকেও জগতের পৃথক নাম ও রূপ আছে। আবার যেমন অলংকারের নাম ও রুপ না থাকলেও স্বর্ণের অভাব হয়, না তেমনি জগতের নাম এবং রুপ না থাকলেও ব্রহ্মের অভাব হয় না। সুতরাং জীবন মুক্তির কাছে জগৎ বোধ না থাকলেও ব্রহ্ম থাকেন। অতএব সেই আত্মজ্ঞানীদের দৈত্য ভাব থাকে না। একেই সমদর্শন বলে।
“যা হওয়ার তা হবেই হবে।- অখন্ড ঈশ্বরই কার্যকারণ ও কর্তারূপে সর্বত্র বিরাজমান। শ্রদ্ধাশীল হয়ে এক হাতে ভগবানকে ধরে থাকো, অন্য হাতে নিরাশক্তবোধে সংসার করো।”
“বিষয়াদির নানাভাবে মিলন এই চিত্তভূমিকে শুদ্ধ করতে ভগবত নামই মহৌষধ। বহির্মুখী.. বা বিষয় মুখী মনকে উল্টিয়ে অন্তরমুখী অর্থাৎ ভগবান মুখে করতে হবে। যে কোন কাজেই ‘তারই প্রিত্যর্থে করছি’ বলে মনে করতে হবে। সংসার ও বিষয়ের আসক্তিতে বদ্ধ না হয়ে, ‘সবই সেই অদ্বিতীয় পরমাত্মার, আমরা কিছুদিনের জন্য এ সকলের জিম্মাদার’ – এইরকম সেবাইৎবোধে সব দেখাশোনা করতে হবে।”
“কোন বাণী বা কথা কার অন্তরে কি ভাবের উদয় হবে, কি ক্রিয়া করবে তা আগে থেকে বোঝা যায় না।”
“বাইরের মূর্খ হীনতা ছেড়ে অন্তরে উল্টে যাও, তাহলে অন্তরমুখে সব সোজা হয়ে।”
“যতদিন হৃদয়ের আসন স্বচ্ছ ও নির্মল না হবে, ভগবান আসা-যাওয়া করবেন। কিন্তু সেই ময়লায় বসবেন না।”
“কোন কারণেই ব্যস্ত হতে নেই, ধৈর্য সহকারে দ্রষ্টাভাবে থেকে সব করে যেতে হয়, কিছুতেই মোহিত বা বিচলিত হতে নেই।
“এক অদ্বিতীয় ব্রহ্ম হয়ে আছেন। এই যে সৃষ্টিপ্রপঞ্চ (জগত) দৃষ্ট হচ্ছে, এটি মায়ার ক্রীড়া। মায়া ব্রহ্ম- আশ্রিত। ব্রহ্মের মায়া শক্তি তার ইচ্ছায়, ‘অজ্ঞান’ তম আবরণ আনয়ন করে। শ্রুতিতে যে ব্রহ্ম হতে সৃষ্টির শুরু বর্ণনা রয়েছে, তা প্রাথমিক বোঝাবার জন্য একটা গৌণ সৃষ্টির বর্ণনা মাত্র।… শ্বাস-প্রশ্বাস যেমন স্বভাবববশত চলতেই থাকে, সেই রকম এই সৃষ্টি প্রপঞ্চ পরমসত্তার নিত্য লীলা।… এটি ঈশ্বরের কালকর্ম সম্পাদিকা মায়াশক্তি সহযোগে এক খেলা।… সত্ত্ব, রজো ও তমো এই তিন গুণ সমন্বিতা মায়াশক্তি অদ্ভুত, অনির্বাচনীয়।”
” ‘তোমরা- তোমরা’ বলে যে কাজ করে তার কোন বন্ধন হয় না। আর ‘আমরা-আমরা’ বলে যে কাজ করে, তার বন্ধন বাড়তেই থাকে- ভাবকে উল্টে দিতে হবে। তাহলেই হয়ে যাবে।”
“জ্ঞান হলো ফল, আর ভক্তি হল রস। … জ্ঞান মিশ্রিত ভক্তি যথার্থ। ‘ইনি আমার ভগবান আমার ইষ্ট’ এই জ্ঞান না হলে ভক্তি আসবে কেমন করে।”
“অনুরাগ তো মানুষের ভেতরেই আছে তবে তার গতির নিম্নমুখী বা আবেগধর্মী। তাকে ঊর্ধ্বমুখী করতে হয়। তার চাররূপের প্রথম মোহ, দ্বিতীয়রূপ স্নেহ, তৃতীয় হলো প্রীতি এবং চতুর্থ ভক্তি। এই মোহ, স্নেহ ও প্রীতি যদি ঊর্ধ্বগামী হয় তখনই তার নাম হয় ভক্তি।”
“নিয়মিত অভ্যাসই স্বভাবে পরিণত হয়। এইজন্যই সাধনায় দীর্ঘকালের আবশ্যকতা হয়। অভ্যাস নিয়মিত না হযে, খেয়ালখুশি মতো হলে, তাতে জৈব প্রবৃত্তির রূপান্তর সম্ভব হয় না। যদি কোন বদ অভ্যাস থাকে তা স্বভাবে পরিণত হওয়ার আগেই বর্জন করা প্রয়োজন।”
“দৌড়ালে আবার বিশ্রামও নিতে হয়। তাই সাধককে এমন গতিশীল হতে হবে যাতে চলার পথে কোন বিরামের প্রয়োজন না হয়, ছেদ না পড়ে , এবং যেন তাল ভঙ্গ না হয়।
“জাগতিক সম্পদ পেয়ে নিজের বলে মনে করে, মিথ্যা বন্ধন বাড়িও না।”
“দেখো তোমার নিজের বলে তো কিছুই নেই। তুমি যখন ছিলে না, তখনও এসব বস্তু ছিল। তুমি যখন থাকবে না, তখনও এসব বস্তু থাকবে। যদি সত্যিই তোমরাই হতো, তাহলে তোমার সঙ্গে এগুলি আসতো এবং যেতও। কিন্তু তা তো হয় না। এসডি রূপান্তর হলেও, আগেও ছিল। এবং পরেও থাকবে।”
“মানবীয় দৃষ্টিকোণ থেকে পারিপার্শ্বিক অনেকগুলো তা ও প্রতিকূলতার বোধ – তারতম্যে জগৎ – ব্যাপারের মধ্যে অনেক অসামঞ্জস্য ও বিপর্যয় দেখা যায়। কিন্তু ভাগবতী দৃষ্টিকোণের অনুভব দেখা যায়, জগতের প্রতিটি স্পন্দনেই রয়েছে লীলার ছন্দময় প্রসারতা ও মঙ্গলের উদ্দেশ্য।”
“আগে চাই নিজের অন্তঃকরণের প্রিহা। তিন কৃপা একত্র হলে তবে হয়, – গুরুকৃপা, ঈশ্বরকৃপা এবং আত্মকৃপা-অন্তঃকরণের কৃপা। অন্তঃকরণের কৃপা না হলে, গুরু আর ঈশ্বরের কৃপা ধারণ করতে পারবে না।- যার অন্তঃকরণ যেমন উপাদানে গড়া, গুরু তাকে তদনরূপ শোধনদ্রব্য দিয়ে থাকেন। তামা, তেতুলের পাত্র তেতুল লাগলেই পরিষ্কার হয়, রুপোর পাত্র খড়িতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তেমনি গুরু কাউকে বলেন ধ্যান করতে, কাউকে জপ করতে, কাউকে পূজা বা যজ্ঞ করতে, আবার কাউকে দান বা পরোপকার করতে।”
“এই মায়া পরমেশ্বর এই দ্যোতনাশীল প্রকাশশীল শক্তি। এই মায়ার শুদ্ধসত্যপ্রধানা রূপকে ‘বিদ্যা’ বলা হয়, এই বিদ্যা মায়ার প্রতিবিম্বিত পরমাত্মাই সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ ঈশ্বর রূপে প্রতিভাত হন। আর এই মায়ারই ‘অজ্ঞান’ প্রধানা রূপকে ‘অবিদ্যা’আখ্যা দেওয়া হয়। এই অবিদ্যামায়ায় প্রতিবিম্বিত পরম চৈতন্যই পরিচ্ছন্নতা প্রাপ্ত অল্পজ্ঞ জীবরূপে প্রতিভাত হয়। ‘অজ্ঞান’ তামসিক আবরণে রাজসিক বিক্ষেপ শক্তি তাদের বদ্ধতাকারী কার্যকর থাকে। অজ্ঞান জীবচেতনা বহিীর মুখী হয়ে যায়।”
“সব কিছুই ভগবানের। তাই স্বয়ং ভগবানকেই যখন ভক্ত নিজের করে নেয়, তখন আর বাকি থাকে কি? ঈশ্বরকে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব পাওয়া হয়ে যায়।”
“বিবেকেই মানুষকে প্রবুদ্ধ করতে সক্ষম। বিবেক থেকে বিচার ও বিচার থেকে বৈরাগ্য বা উপেক্ষা আসে। প্রলোভনে উপেক্ষা ও শাস্ত্রে স্বাদ্ধ্যায় সাহায্যে চিত্তের নির্মলতা আসে।”
“উপনিষদ, গীতা এবং বিভিন্ন পুরানাদি তথা সৎ গ্রন্থের সঙ্গ করলে কত ব্রহ্মাশ্রী, দেবশ্রী, মহর্ষি, রাজর্ষির পূতসঙ্গ পাওয়া যায়। যাদের একটিমাত্র উপদেশও পালন করতে পারলে জীবন ধন্য হতে পারে।”
“লোকে বলে ‘আমার মন’, সে বোঝেনা যে, মন যদি তার হত তাহলে তো সর্বদাই তা তার বসে থাকতো। সে মনকে নিজের ইচ্ছামত চালাতে পারতো। কিন্তু সে তা পারে না, মনই তাকে চালিয়ে থাকে। মনের ওপর যদি তার ঠিক মতো অধিকার হয়, সে জগৎজয়ী হতে পারে। সেই জন্যই তো সাধনার দরকার। তার জন্য চাই তীব্র আগ্রহ।”
“অনেকে জপ করে, এবং তার ফলে চিত্তের মালিন্যও দূর হতে থাকে। কিন্তু পরে পরনিন্দা, পরচর্চায় চিত্ত আবার মলিন হয়ে যায়।”
“শিষ্য যদি শতছিদ্র অন্তঃকরণের কলসিতে গুরুর- উপদেশ সমূহ ধরে রাখতে নাও পারে, তাহলেও উপদেশরূপ ঘৃতের উজ্জ্বল্যতাতে সামান্য হলেও লেগে থাকবেই। তাতেও তো কিছু লাভ হবে। তাই সৎসঙ্গ করো।”
“সদাচারহীন মানুষের ধর্মজীবন লাভ দূরে থাকে, ভদ্র নৈতিক জীবনই লাভ হয় না। সর্বাগ্রে সদাচারী ‘মানুষ’ হওয়া বিশেষ কর্তব্য।’
“বহির্মুখী বা ইন্দ্রিয় সুখের জন্য যে ইচ্ছা তাকেই কামনা বলা হয়।- অন্তর্মুখে ইন্দ্রিয়ািত আত্মপ্রসাদ প্রাপ্তির জন্য যে ‘কামনা’ তা নিষ্কাম বললে কোন ভুল হয় না।”
“সমস্ত জগতের একমাত্র কর্তা, ধর্তা, হর্তা ও সর্বশক্তিমান সর্বময় শ্রীভগবানকে সতত স্মরণ পথে রেখে সবকিছু তারই জেনে তারই পূজার আয়োজনে কর্তব্যকর্মের আচরণ দ্বারা জীবন ধারণ করো। এইভাবে নিজের জীবনকে তার শ্রীচরণের সমর্পণ করে দাও”
“উচ্ছ্বাসমূলক ভক্তি হয় ক্ষণস্থায়ী, আবেগসর্বস্ব, তাতে ভগবান ধরা দেয় না। যা স্থায়ী অব্যভিচারিনী, অনুরাগমূলক ভক্তি তার দ্বারাই তাকে লাভ হয়।
“সবই সে তিনি নিজেই। সেজন্য তিনি তোমাকে কখনো পৃথক করতে পারেন না। বা তুমিও তার থেকে পৃথক হতে পারো না।
“ঈশ্বরকে প্রধানত দুইভাবে উপলব্ধি করা যায়। বিধিভাবে এবং নিষেধভাবে। জ্ঞানীর কাছে জগৎ মিথ্যা, একমাত্র ব্রহ্মই সত্য এবং জীবও স্বরূপতঃ ব্রহ্মই। – এই হল ‘নিষেধ’ বাক্য – সবকিছুকে বাদ দিয়ে ব্রহ্মোপলব্ধি। আর ভক্তের কাছে, জগতে যা কিছু সবই শ্রীহরিময়। তিনি ছাড়া আর কিছুই নেই।’ – এই হল ‘বিধি’ বাক্য। যে পথেই হোক ঈশ্বরকে ডাকা চাই, লাভ করা চাই।”
“ভক্তি সাধনের নয়টি ধাপ। সেগুলি হল শ্রাবণ, কীর্তন, স্মরণ, পাদসেবন, অর্চন, বন্দন, দাস্য, সখ্য, ও আত্মনিবেদন। এই ধাপ গুলিকে ক্রমে ক্রমে সাধন করতে হয়, একেবারে হয় না। সবশেষে আসে আত্মা নিবেদন এবং তখনই তুমি ভগবানের হয়ে যাবে এবং ভগবান হয়ে যাবেন তোমার।”