মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯০৮ সালের মে মাসে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্টের ঝাড়খন্ডে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন একজন ছোট গল্পকার, সাহিত্যিক এবং স্বাধীনতা সংগ্রামী ব্যক্তি। ইনি ১৯৫৬ সালের ডিসেম্বর মাসে স্বাধীন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। এনার কিছু উপদেশ নীচে উল্লেখ করা হলো। –
“পশুপাখির যৌন ব্যাপারের মতোই মানুষেরও যৌন ব্যাপার—নিজেদের নতুন করে সৃষ্টি করা আর বাঁচার লড়াই চালিয়ে যাওয়া। মানুষের যৌন ব্যাপারে আরেকটা বাড়তি বাস্তব ব্যাপার আছে প্রেম। কাব্য সাহিত্যে ফেনিয়ে ফাঁপিয়ে রঙ দিয়ে এই বাস্তব রহস্যটাই ব্যাখ্যা করার চেষ্টা হয়ে আসছে। ফেনা আর রঙ ব্যাখ্যা করে বাতিল করে যৌনবিজ্ঞান প্রেমের মানে বোঝাতে চেয়ে পারেনি। শরীরবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, যৌনবিজ্ঞান, প্রেমের এদিক ওদিকে সেদিকটা বুঝিয়েছে, প্রেমকে বোঝাতে পারেনি।”
“অন্নই আসল জীবন। ব্যাঞ্জন নয়, স্বাদ-গন্ধ নয়।”
“গুণ্ডারা সামাজিক জীব, সমাজের বিকার ওদের চালায়।”
“আনন্দ ব্যথা ভয় এইসব উত্তেজনা মনে দেখা দিলেই শরীরের অনেকগুলি গ্লান্ড থেকে রসস্রাব শুরু হয়। আনন্দ কম আর স্বাভাবিক হলে যে রস বার হয় শরীরের তাতে উপকার হয়, কিন্তু অস্বাভাবিক প্রবল আনন্দের রস ঠিক বিষের মতো কাজ করে।”
“মানুষের মনকে যখন বারুদে পরিণত করে রাখা হয়েছে তখন বড় জোর আগুনের ছোঁয়াচ এড়িয়ে চলার বিবেচনাটুকু তার থাকতে পারে, স্ফুলিঙ্গ এসে ছুঁইয়ে ফেললে বারুদের জ্বলে ওঠা আর ঠেকানো যায় না ।”
“বড়লোক যদি হইতে চাও মানুষকে ঠকাও, সকলের সর্বনাশ করো। তোমার জন্মগ্রহণের আগে পৃথিবীর সমস্ত টাকা মানুষ নিজেদের মধ্যে ভাগ করিয়া দখল করিয়া আছে। ছলে-বলে কৌশলে যে-ভাবে পার তাহাদের সিন্দুক খালি করিয়া নিজের নামে ব্যাঙ্কে জমাও।”
“দেশের মুক্তি যার যত বেশি কাম্য, স্বাধীনতার আদর্শ যার কাছে যতবড় সত্য, যে যত বেশি নির্ভীক, বেশি তেজস্বী, কর্মঠ জীবন্ত, সে-ই যেন তত বেশি উন্মাদ বিপ্লবে ঝাঁপ দিতে, প্রাণ দিতে দেরি যেন তারই ততই বেশি অসহ্য। অথচ এ দেরি চাই বিপ্লবী দল গড়তে, অথচ ধীর শান্ত নিরুদ্বেগ অহিংস ভালোমানুষের যৌবনে বিপ্লব নেই ।”
“ঐক্যের খাঁটি বাস্তব ভিত্তি দেখেছি মজুরদের মধ্যে। এত কাণ্ডের মধ্যেও মজুরশ্রেণি: স্থির রয়েছে। কারো ভাঁওতায় ভোলেনি, উস্কানিতে বিচলিত হয়নি, হানাহানি দেখে উত্তেজিত হয়নি, বরং এগিয়ে গিয়ে, দাঙ্গা থামিয়েছে। মজুররাই এগিয়ে গিয়ে দাঙ্গা থামাতে পারত, ঐক্যগঠনে নেতৃত্ব দিতে পারত। এটা আমাদের খেয়াল হয়নি, আমরা কংগ্রেস লীগ আপোসের ভরসায় থেকেছি।”
“এ কথা কে না জানে যে পরের টাকা ঘরে আনার নাম অর্থোপার্জন এবং এ কাজটা বড় স্কেলে করিতে পারার নাম বড়োলোক হওয়া।”
“দেহ তো আর অশ্লীল নয়, দেহের চেতনাও নয়—ওই চেতনার বিকৃতিই শুধু অশ্লীলতা।”
“অকর্মণ্য বাজে লোকের একটা নেশাকে প্রেম বলে চালানো হয়। সত্যিকারের মানুষের প্রেমে বাড়াবাড়ি থাকে না।”
“ব্যর্থ প্রেম কিছু না, বিরহ শুধু মনের কষ্ট, ও সমস্তের জন্য মানুষের খুব বেশি আসে যায় না। ছেলে স্বর্গে গেলে মাকেও তো তা সহিতে হয়। কিন্তু সবচেয় ভয়ানক মনে হয় ট্রাজেডিটা, যখন বুঝিতে পারা যায় যাকে ভালোবাসিয়াছিলাম তার হৃদয় হৃদয়ের রীতিনীতি মানে না। আমাকে সরল ভালোমানুষ পাইয়া, আমার প্রথম যৌবনের অমূল্য সম্পদটুকু সে আমাকে ঠকাইয়া গ্রহণ করিয়াছে—শুধু একটু মজা করিবার জন্য।”
” ব্রিটিশ করাচ্ছে মারামারি, ব্রিটিশ করে দিচ্ছে ভাগাভাগি মিটমাট সে কি দেশের সাধারণ মানুষকে খাঁটি স্বাধীনতা দেবার জন্য ;নিশ্চিন্ত মনে যাচাই করতে দেওয়ার জন্য ?”
“ক’দিন আর লাগবে এ স্বাধীনতা তিতো হতে, দেশের লোকের চোখ খুলতে, যাদের গর্জনে ব্রিটিশ পিছু হটছে, আবার তাদের গর্জন শোনা যাবে হিন্দুস্তানে, পাকিস্তানে সত্যিকারের স্বাধীনতা চাই।”
“স্বাধীনতা হচ্ছে রিয়ালিটি—রিয়ালিটিকে মূল্য দিতে না শিখিলে স্বাধীন হওয়া যায় না ৷”
” প্রেমকে যারা বাস্তব জীবনের চেয়ে বড় করে তোলে, জীবনের আর সমস্ত সার্থকতা তুচ্ছ হয়ে যায় যাদের কাছে, মানুষ হিসাবে তাদের বেশি মূল্য নেই।”
” ভয় মানুষের তৈরী। স্বার্থপর মানুষের।”
“দান এগিয়ে গিয়ে সবার আগে নিতে হয়, নইলে ফুরিয়ে যায়।”
” নীতি ছাড়া কি মানুষের চলে। এ কিন্তু শূন্যে তোলা ফাঁকা নীতি নয়। বনের মানুষেরও নীতি ছিল। নীতি নিয়েই মানুষই এগিয়েছে, হাজার হাজার বছর ধরে বাস্তব অবস্থাকে বদলে নিজেকে উন্নত করেছে। কিন্তু একটা নীতি নিয়ে নয়—যে নীতি যখন মিথ্যা হয়ে গেছে, মানুষকে এগোবার বদলে পিছনে টেনে রাখতে চেয়েছে, তখন মানুষেরই অগ্রণী অংশ প্রাণের মায়া ছেড়ে লড়াই করে নূতন নীতি চালু করিয়েছে—মানুষকে বাঁচিয়েছে।”