স্বামী সন্তদাস বাবাজী ১৮৫৯ সালের জুন মাসে বর্তমান বাংলাদেশের সিলেটে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনার জন্মকালীন নাম ছিল তারাকিশোর চৌধুরী। তিনি একদিকে ছিলেন যেমন ধর্মগুরু অপরদিকে ছিলেন একজন দার্শনিক। ইনি ১৯৩৫ সালের নভেম্বর মাসে বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মাথুরাই মৃত্যুবরণ করেন। এনার কিছু মোটিভেশন বাণী নীচে উল্লেখ করা হল।-
“ব্রহ্মবিদ হওয়ার অর্থ সহজ, স্বাভাবিক হওয়া।… যে অবস্থায় প্রত্যেক জাগতিক বস্তুকে ব্রহ্মেরই অঙ্গীভূতরূপে দর্শন হয়, তা-ই জীবন্মুক্ত অবস্থা।”
* ব্ৰহ্ম ‘সৎ’ বস্তু, আনন্দই তাঁর স্বরূপ। এই আনন্দ ‘চিৎ’ শক্তিযুক্ত। এই চিৎশক্তিএমন যে, তার দ্বারা তিনি আপন স্বরূপগত আনন্দকে অনন্তরূপে বিষয় করতে পারেন এবং নিত্য করে থাকেন। ওই চিৎশক্তি দ্বারা আপন স্বরূপ ‘আনন্দ’ কে যে অবস্থায়’ অনন্তরূপ বিশিষ্টভাবে সম্যক (সামগ্রিক) দর্শন করেন সেই প্রকাশটিকে ‘ঈশ্বর’ বলা যায়। আবার, সেই চিৎশক্তিরই যে অবস্থায় ব্রহ্ম স্বরূপানন্দকে পৃথক পৃথক বিশিষ্টরূপে এবং ওই রূপসমূহকে ভিন্ন ভিন্ন ব্যষ্টি (অসম্যক) ভাবে দর্শন করেন তখন সেই (ক্ষুদ্র) প্রকাশগুলিকে ‘জীব’ বলা হয়। ব্রহ্মের স্বরূপানন্দ তাঁর চিৎশক্তির যে অবস্থায় কেবল ভোগ্য বা ভোগ্যযোগ্য রূপে অনুভূত হয় তা-ই ‘জগৎ’ তথা ‘অচেতন’ রূপে সংজ্ঞায়িত হয়।”
“জগতের প্রত্যেক কার্যের কর্তা প্রভু স্বয়ং। প্রত্যেক জীবের প্রত্যেক কার্য, প্রত্যেক চিন্তা জগতের প্রত্যেক ঘটনা, অনন্ত জগতের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে আছে অকাট্যভাবে। এ সবের প্রতিটিকে (সৃষ্ট) উৎপাদন করার জন্য অনন্তভাবে অনন্তকাল ধরে ‘অনন্ত’ই আয়োজন করছেন। জগতে কোনো কার্য এমন কি (তথাকথিত) পাপ কার্যও আকস্মিক নয়।”
“‘আমি বোধ করি আমি স্বাধীন; আমি ইচ্ছা করলে আসতে পারি, নাও আসতে পারি, কোনো কোনো কাজ আমারই ইচ্ছার অধীন’ এ কথা যদি তুমি মনে করো, তাহলে এর পরের অবস্থাতে যাও। দেখো, তোমার ইচ্ছাটার তো কারণ আছে। সেই ‘কারণ’ তোমার অধীন নয়। তাহলে ইচ্ছাটার মালিক কি তুমি? ধরো, তুমি ইচ্ছা করলে যে, ‘ক্রোধ’ করবো না’, কিন্তু এমনই ঘটনা ঘটলো যে ক্রোধে উত্তেজিত হয়ে উঠলে। আসলে যেরূপ শিক্ষা (ও অভিজ্ঞতা) পেয়ে এসেছো, তদনুযায়ী ‘সংস্কার’ যদি বলবান হয় তবে তোমাকে সেই সংস্কার চালাবে। সেই সংস্কার তোমার অধীন নয়। ইচ্ছার ‘কারণ’ আছে, সেই ‘কারণ’ তোমার অধীন নয়। সংস্কারগুলির জন্ম হয়েছে কর্ম থেকে। পূর্বজন্মের সংস্কারে (দৈবে) এ জন্মের শিক্ষার (পুরুষকারের) দ্বারা কর্ম করে যাচ্ছ। পূর্বজন্মের কর্মফলানুযায়ী তোমার এই জীবনের ‘পরিবেশ’ হবে। দৈব যে ফল দেবে, তা-ই বর্তমান জীবনের কর্মস্রোত ঠিক করে নেবে।”
“প্রথমেই ‘আমি কর্তা’ এই বোধটি যায় না। বুঝতে হবে যে, ফল তো আমার হাতে নয়। কর্তব্যবুদ্ধিতে কাজ করে যাবো, তাতে কী ফল হবে জানি না। তাহলে ফলের জন্য চিন্তা করে ক্লেশ পাই কেন? আমার ভালো হলে তিনি ফল তো দেবেনই, না হলে দেবেন না’–এইটিই প্রথম অবস্থা। এতে ক্রমে চিত্তশুদ্ধি হয়। পরে সাধকের ধারণা হয় যে, ‘আমার তো কর্ম কিছুই নেই’……সে ক্রমশঃ হৃদয়ঙ্গম করতে থাকে যে, বাস্তবিক তার কর্মসামর্থ্যও নিজের নয়, এটিও ভগবৎ প্রেরিত এবং সে নিজেও পৃথক, স্বতন্ত্র নয়, জগতের সঙ্গে একসূত্রে গাঁথা আছে।”
“ঈশ্বর ও জীব উভয়েরই দৃশ্য বস্তু এক ‘সৎ’ ব্রহ্ম। ঈশ্বর ‘সৎ’ ব্রহ্মকে সম্যকদর্শন করেন, জীব ঈশ্বরের অধীনে থেকে সেই ‘সৎ’ ব্রহ্মের (লীলাগত) বিশেষ বিশেষ অংশ দর্শন করে। এইটিই জীব ঈশ্বরের প্রকাশগত ভেদ।”
“স্কল বস্তুই ব্রহ্মময়- এই কথাটি খালি বুদ্ধি দ্বারা বিবেচনা করেই যে লোক অগ্নিতে হাত দেবে তারও হাত দগ্ধ হবে, যে হলাহল পান করবে তার মৃত্যু ঘটবে। ওটি প্রকৃত ব্রহ্মজ্ঞান নয়। কারণ অগ্নি ও হলাহলে ভগবানের সৃষ্ট যে বিশেষ শক্তি আছে, তার প্রতি অবজ্ঞা করে ওই ব্যক্তি মূঢ়বুদ্ধি বশতঃই ওইরূপ কার্যে প্রবৃত্ত হয়। বস্তুতঃ যথার্থ ব্রহ্মজ্ঞ প্রত্যেক বস্তুতে নিহিত শক্তিকে (বিশেষ ক্রিয়ার জন্য সৃষ্ট) ভগবৎ শক্তি জ্ঞানে পূজা (বিবেচনা) করেন, তাকে কখনো অবজ্ঞা করেন না।…..ক্ষুদ্রতম একটি পরমাণুতে যে শক্তি আছে সেটিও জগতের একটি অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গ।”
“যদি তোমার বিচারকার্য করতে হয়, তখন অবশ্যই সাধ্যমতো প্রত্যেক বিচার্য বিষয়ে যথার্থ সত্য কি তার অনুসন্ধান করবে। ভগবৎ প্রেরণায় যেদিকে সত্য বলে ধারণা হবে, তদ্রূপ নিষ্পত্তি করবে এবং তারপরে মনে আর কোনো খট্কা রাখবে না। তা অপরের বিবেচনায় যদি ‘ঠিক’ সাব্যস্ত না হয়, তাতেও ক্ষুব্ধ হবে না। তোমার যা কর্তব্য তা যথাসাধ্য সম্পাদন করে সর্বদা সন্তুষ্ট চিত্তে থাকতে চেষ্টা করবে।”
“বস্তুতঃ কোনো দুটি বস্তু জগতে ঠিক একরূপ নয়। প্রত্যেক বস্তুতেই কিছু বিশেষত্ব থাকে যা অপরের মধ্যে নেই। এইটির দ্বারা ব্রহ্মসত্তার অনন্ততাই প্রকাশ পায়।
“মান অপমান সকলেরই জীবনে ন্যূনাধিক পরিমাণে উপস্থিত হয়। এইজন্য ব্যস্ত হওয়া কাপুরুষের কাজ। চিরদিন সমান যায় না, বিপদও কারোর স্থায়ী হয় না। উৎসাহের সঙ্গে কর্তব্যটুকু করে যাও।”
“অনন্তরূপে প্রকাশিত বিশ্বে সমষ্টিভাবে যে চিৎশক্তি প্রবিষ্ট আছে তা বিশ্বরূপ দেহ-পুরে অবস্থিত বলে তাঁর ‘পুরুষ’ সংজ্ঞা হয়ে থাকে, ইনিই হিরণ্যগর্ভ, কার্যব্রহ্ম, ব্রহ্ম, অনন্তদেব ইত্যাদি নামে অভিহিত হয়েছেন। ইনিই ব্রহ্মের ব্যক্ত মূর্তরূপ, এই অনন্ত বিশ্বই তাঁর দেহ। এই অনন্ত বিশ্বের, ক্ষুদ্রতম থেকে বৃহত্তম প্রত্যেক অংশে চিৎশক্তি প্রবিষ্ট আছে।”
“ব্যষ্টিগত দর্শনশক্তি রূপে পরমের ‘চিৎকণা’ প্রত্যেক জীবদেহে অনুপ্রবিষ্ট আছে, সুতরাং প্রতিটি জীবদেহই চিৎশক্তিবিশিষ্ট হওয়ায় প্রত্যেকেই এক একটি ‘পুরুষ’ এই পুরুষের সংখ্যা অনন্ত, কারণ ব্যষ্টিরূপও অনন্ত। বাস্তবিক কেউ কাউকে দুঃখ বা সুখ দিতে পারে না। প্রত্যেকের নিজ নিজ ‘অহং’ বোধে কৃতকর্মই অপর কাউকে ‘নিমিত্ত’ রূপে খাড়া করে সুখ বা দুঃখ দেয়। এইটি ঠিক ঠিক জানলে, তার কারো প্রতি আসক্তি, বিদ্বেষ, হিংসা, ঘৃণা প্রভৃতি আসে না।”
“প্রত্যেকের জীবনের প্রতিটি কার্যের ফলই সমগ্র বিশ্বব্যাপী ছড়ায়। যতো ক্ষুদ্রই হোক। প্রত্যেক বস্তু, প্রত্যেক কার্যই সমগ্র জগতের সঙ্গে সম্বন্ধবিশিষ্ট। কোনো একস্থানে বাহ্যতঃ সেটি সুখ-দুঃখ ফলোৎপাদন করতে পারে বটে, কিন্তু বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ‘ভারসাম্য’ রক্ষা করতে ওই কাজটি একটি অনিবার্য অত্যাবশ্যক স্পন্দন।”
“স্তোত্রপাঠের সময় ‘দেবতা’ উপস্থিত হন। তাচ্ছিল্যভাবে স্তোত্রপাঠ বড় অপরাধ । যাদের চিত্ত নির্মল, তাদের হৃদয়ে কোনো প্রার্থনা উদিত হলে তা কল্যাণকর স্থলেই উদিত হয় এবং তা সাক্ষাৎ সম্বন্ধে পূর্ণও হয়ে থাকে। এতে ভগবানের কোনো পক্ষপাতিত্ব নেই।”
“গুরুশক্তিটি বাস্তবিক এক শক্তি। একজন গুরুকে ছেড়ে অন্য সদ্গুরুর কাছে দীক্ষা নিলে পূর্বগুরুকে ত্যাগ করা হলো না। পূর্বগুরুর শিক্ষাই তো ছিল প্রথম শিক্ষা, তা থেকেই তো অ-আ, ক-খ শিক্ষালাভ হয়েছে। তারপর অন্য গুরুর কাছে শিখে স্নাতক হলে।”
“জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে জন্মের সময় নবগ্রহের দশানুযায়ী মানব জীবন নিয়ন্ত্রিত হয়। কিন্তু নবগ্রহ মাত্র সূর্যমণ্ডলে অবস্থিত। সূর্যমণ্ডল ধ্রুবমণ্ডল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, ধ্রুবমণ্ডল সপ্তর্ষিমণ্ডল দ্বারা। সুতরাং নবগ্রহের ফলাফল বদলে যেতেই পারে উচ্চতর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দ্বারা….। এই পরিবর্তনও ঘটে সুক্ষ্মস্তরীয় নিয়মেই, আকস্মিক কিছুই নয়।”
“নর-নারীর মধ্যে যে মিথুনভাবের আকর্ষণ, তা আদৌ আকস্মিক ও অস্বাভাবিক…..পশু পক্ষী, কীট-পতঙ্গ এমনকি বৃক্ষলতাদিতেও এটি দৃষ্ট হয়। এটি সৃষ্টি বৃদ্ধির মূল। সর্ববিধ মায়িক আকর্ষণ অপেক্ষা এটির বল অধিক।…ভগবৎঅঙ্গে এই শক্তি না থাকলে বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ড লুপ্ত হতো।……এটিকে অবহেলা করবে না। যতো অবজ্ঞা করবে ততো তোমাকে জব্দ করবে।….প্রার্থনার ধারায় (কামাসক্তিকে) সহজে জয় করা যায়।…..ব্রহ্মাদি ভিন্ন কেউই কামাকর্ষণকে সম্পূর্ণরূপে অতিক্রম করতে পারে না।”
” ‘অনুভূতি’ সব সময় বোঝা যায় না। কখনো দেখছো উঁচুতে উঠছো, কখনো মনে হয় নামছো; কিন্তু অতে অগ্রসর হবার পথে বাধা হয় না । সংস্কার মুক্তির চেষ্টা নামই সাধন। এই সাধন সময়সাপেক্ষ। বহু জীবনের (গ্রথিত এই) সংস্কার দূর করতে হলে ধীরে ধীরে পরিশ্রম করা চাই। যখন যেমন হয়, সেইভাবে কাজ করবে। তোমার কী হবে? চিন্তায় কী আসে যায়? এতে অশান্তি ছাড়া আর কিছু হয় না। কর্তব্য নির্ধারিত করে তা-ই সম্পাদন করতে হবে।’—এই রকম মনের অবস্থা রাখতে পারলেই শান্তি পাবে।”
“রজোগুণ নিয়েই সংসারের কাজ চলে। তবে দু-রকম আছে। সত্ত্বগুণের অধীন হয়ে রজোগুণের কাজ, আর তমোগুণের অধীন হয়ে রজোগুণের কাজ। সত্ত্বগুণের অধীনতার চিহ্ন হচ্ছে প্রসন্নতার সঙ্গে কাজ করা, আর তমোগুণের অধীন হলো অভিমান, হিংসা, বিদ্বেষ।”
“শয়তান বলে আলাদা কোন শক্তি নেই। সবরকম কাজ ঈশ্বরেরই যে অঙ্গ দিয়ে যে কাজ ইচ্ছা করেন, সেকাজ কীভাবে করছেন তা বোঝা কঠিন।…নিয়ন্তা একমাত্র তিনিই।”
“ইন্দ্রিয় ভোগের দ্বারা মানুষ ‘আনন্দ’ চায়। পাপ-পূণ্য যে কোনো কাজই করুক না কেন ‘আনন্দ’ পাবে বলেই করে। আনন্দ যে একেবারে পায় না তা নয়, কিন্তু অবশেষে দেখা যায়, এ আনন্দ স্থায়ী নয়, অল্পকাল পরেই ‘ফুরিয়ে যায়; কাজেই আশা মেটে না।….(নিত্য বোধক) আনন্দ পাবার চেষ্টায়, সংসারের কোনো বিষয়ের প্রতি আসক্তি না রেখে, ভেতর থেকে সমস্ত তৃষ্ণা দূর করে দিতে হবে। আসক্তি ত্যাগই হলো সার।”