শ্রীমৎ স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ ১৮৬৩ সালের জুলাই মাসে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্টের হুগলি জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের একজন প্রত্যক্ষ শিষ্য ছিলেন। শৈশবকালে এনার নাম রাখা হয়েছিল শশী ভূষণ চক্রবর্তী। ইনি একজন অদ্বৈত বেদান্তে বিশ্বাসী হিন্দু ধর্মগুরু ছিল। অবশেষে ১৯১১ সালের আগস্ট মাসে শেষ জীবন ত্যাগ করেন। এনার কিছু উপদেশ নিছে উল্লেখ করা হলো।
“সসীম কখনো অসীমকে জানতে পারে না। কিন্তু অসীমের স্বরূপ বুদ্ধি-বিচার দিয়ে কিছুটা ধারণা করতে পারি; তা না হলে এটা লাভ করতে আমরা এত আগ্রহ করতাম কি? প্রকৃতি থেকে আমাদের সকল শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। প্রকৃতি ঈশ্বরের অনাদি গ্রন্থ। যিনি এটা মনোযোগ সহকারে পাঠ করতে পারেন, তিনিই ধন্য।”
“যা মানুষকে ভগবানের নিকট নিয়ে যায় তা-ই নীতি। যা দূরে সরিয়ে দেয় তা অ-নৈতিক। বাইরের রীতিনীতি, আচার অনুষ্ঠানাদি দর্শনে কোনো ধর্মকে ছোট বা বড় বলা উচিত না। সত্যোপলব্ধিই ধর্মের উদ্দেশ্য। ধর্মের বহিরঙ্গ দেশ-কালভেদে পৃথক হলেও তার উপযোগিতা আছে। অনুষ্ঠানগুলির আবরণে ধর্মের প্রাণশক্তি সংরক্ষিত হয়।”
“ভক্তির শক্তিতে ‘আমিত্বে’র বিনাশ হয়। ঈশ্বরে আত্মসমর্পণই ভক্তি। ধর্মের অর্থ পরোপকারের ইচ্ছা এবং সর্বশক্তিমানের ইচ্ছার ওপর আত্মসমর্পণজনিত পরিতৃপ্তি লাভ।”
“ঈশ্বর ভালো মন্দ দুই-ই সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু তিনি ভালো-মন্দের পারে এবং তাঁর ইচ্ছায়ই একে অপরের বিরুদ্ধাচরণ করে। তিনি সাক্ষীস্বরূপ সবই দেখছেন। সুখ-দুঃখরূপ-দ্বন্দ্বগুলি ঈশ্বরের লীলামাত্র।”
” এ জগতের প্রত্যেক সাধকই শাক্ত। শক্তির আরাধনা করেন না, এমন কে আছেন ? শক্তিহীন ঈশ্বরকে কে উপাসনা করেন?”
“স্বভাবজাত প্রবৃত্তির তাড়নায় মানুষ কর্ম করে। ক্রমে সে বুঝতে পারে একটি উচ্চতর শক্তি মানুষের শুভাশুভ কর্মানুযায়ী ফলদাতা ভাগ্যনিয়ামক। তাঁকে প্রসন্ন করার জন্য মানুষ তাঁর আরাধনায় প্রবৃত্ত হয়, কারণ সেই শক্তি প্রসাদেই তার অভ্যুদয় সম্ভব। প্রবৃত্তিমার্গ ত্যাগ করে নিবৃত্তিমার্গে সেই শাশ্বতসুখ লাভ হয়।”
“চরাচর সমস্ত জগৎ মহাকালশক্তি কালীর অধীন। এই কালশক্তিই সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের কারণ। তিনিই ব্রহ্ম নামে অভিহিত। ব্রহ্ম নিত্য, দেশ-কাল-নিমিত্তের অতীত। জগৎ দেশ-কাল-নিমিত্ত হতে সৃষ্ট ও মিথ্যা। ‘মিথ্যা’ শব্দের অর্থ আদি ও অন্তযুক্ত অনিত্য; ‘মিথ্যা’ অর্থে শূন্য নয়।”
“মানুষ মনে করে নিজের ইচ্ছামতো কাজ করছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বর তার সকল কর্ম ও চিন্তা পরিচালনা করছেন। মানুষ অকর্তা। আমরা যখন তা বুঝতে পারি তখন আমাদের অহংকার, উচ্চাভিলাষ ও গর্ব চূর্ণ হয়। সুতরাং যারা নিজেদের ‘ঈশ্বরের হাতের যন্ত্র’ – এ কথা বুঝতে পারে তারাই ভাগ্যবান, তারাই নিশ্চিন্ত। যিনি ঈশ্বরলাভ করেছেন তিনি কখনো ‘অভাব’গ্রস্ত হন না।”
“মৃত্যুর অবশ্যম্ভাবিত্ব এবং পার্থিব সুখের ক্ষণিকত্ব, মানুষকে বিশ্বপ্রকৃতি ও মানবজীবন বিশ্লেষণ করতে প্রণোদিত করে। ফলে শাশ্বত সুখ আবিষ্কৃত হয়। আত্মজ্ঞান তথা বিশ্বপ্রেম দ্বারাই মানুষ ইন্দ্ৰিয়াতীত দশায় পৌঁছে অনন্ত সুখের উৎস দেখতে পায়। সংশয় গ্রন্থির পরপারেই অপরূপ জ্যোতি ও অপার আনন্দসাগর … সদাপূর্ণ অমর (আত্মচৈতন্য)।”
“ঈশ্বরের শক্তি মানুষের মধ্যে নিহিত, কিন্তু সুপ্ত। ধর্মরাজ্যে আমরা যতই অগ্রসর হবো, অন্তর্নিহিত শক্তি ততই স্বতঃপ্রকাশিত হবে।”
“স্বীয় কর্তব্য করে যাও। উদ্বিগ্ন হয়ো না, ভবিষ্যতের কথা ভেবো না। অহংকার যতই কমাতে পারবে, ততই তুমি গন্তব্যস্থলের নিকটবর্তী হবে। যেক্ষণে তুমি তা একেবারে ত্যাগ করবে, সেই ক্ষণেই মুক্তি হবে তোমার করতলগত। তোমার সম্মুখে ও পশ্চাতে অনন্তজীবন প্রসারিত।”