শ্রীমৎ বরদাচরণ মজুমদার ১৮৮৬ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুর্শিদাবাদ জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ছোটবেলা থেকেই এনার পড়াশোনার পদে ছিল গভীর আগ্রহ, তাই পরবর্তীকালে ইনি একজন শিক্ষক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। শিক্ষাকতার পাশাপাশি তিনি একজন লেখক ছিলেন। অবশেষে ইনি ১৯৪০ সালে মারা যান। এনার কিছু বাণী নিচে উল্লেখ করা হল।
“সংসারী মানুষ জ্ঞান-বিজ্ঞান, নীতি-ধর্ম ও প্রবাদের সু-সংস্কার, কু-সংস্কারের আওতায় – সারাজীবন বসবাস করে। ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিতের অপরিস্ফুট একটা ধারণা তার প্রত্যেকটি চিন্তায় ও কর্মে প্রভাব বিস্তার করে। অবচেতন মনের পীড়নে সে বারংবার জর্জরিত হয়েও মুক্তির দিশা পায় না।…..তার মনের জ্ঞাত অজ্ঞাত সমস্ত দুঃখের মূলে যে অব্যক্ত এক আনন্দেরই খেলা চলছে এ সন্দেহ তার মনে উদয় হয় না। …. সেই ‘তিনি’ই যে একাধারে নাট্যকাররূপে এবং বিশ্বরঙ্গমঞ্চের অভিনেতা রূপে বিভিন্ন ভূমিকায় প্রতিফলিত হচ্ছেন, বিভিন্ন চরিত্রের সৃষ্টি করে, ভাবে লীলা করছেন, সেই স্রষ্টাই যে অন্ধপরমান্ধর মধ্যে প্রতিভাষিত হচ্ছেন, সেই সত্যটি তিনিই ভুলিয়েও দিচ্ছেন জীবমানসে।”
“মূর্তিধ্যান, মন্ত্র জপ বা জ্যোতিঃ ধ্যান প্রকারান্তরে একই কথা। কারণ তার ফলস্বরূপ স্পন্দন অনুভব করা যায়। স্পন্দনের গতি মূলাধার থেকে মেরুদণ্ডের মধ্য দিয়ে সুষুম্মাপথে মস্তিষ্কমধ্যে সহস্রারে যাতাযাত করে থাকে। তাই যে সাধনপথই অবলম্বন করা হোক, তাতে মন-প্রাণ দিয়ে কাজ করলে সুষুম্নাপথ আপনা থেকেই খুলে যাবে এবং তখন বোঝা যাবে যে, বিভিন্ন মত অবলম্বন করে চললেও শেষ পর্যন্ত একই (সুষুম্না) পথ মিলবে এবং উদ্দেশ্যও সহস্রারে একই বলে, ধারণায় আসবে।…প্রত্যেক পথ শেষ পর্যন্ত একই পথ নির্দেশ করে থাকে এবং উদ্দেশ্যও চিরকালই এক ভগবৎপ্রেম লাভ করা, এবং তাই প্রকৃত জ্ঞান।”
“এক থেকে বহু হওয়ার ইচ্ছা যেমন স্বাভাবিক, তেমনই বহু হওয়ার ইচ্ছা গুটিয়ে একের মধ্যে ডুববার প্রবল ইচ্ছাও স্বাভাবিক। যে শক্তি কেন্দ্রে টেনে নিচ্ছে সেই শক্তিই আবার সীমাহীন পরিধির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। … সকলের মধ্যেই এর সম্ভাবনা রয়েছে, কারণ এটি সনাতন সত্য-গতি। ….. প্রত্যেকেই আমরা এই উভয় খেলার মাঠ নিয়ে অভিনয় করছি। কখনো খেলা সাঙ্গ করার জন্য সমস্ত গুটিয়ে একের মধ্যে মিশিয়ে নেবার চেষ্টা, কখনো বা বিকাশ পাওয়ার জন্য আয়োজন। এই দুই খেলার সঙ্গী হতে পারলে ঠিক খেলতে পারা যাবে; সুখ দুঃখ বোধ বা কোনোপ্রকার চাঞ্চল্য মনে স্থান পাবে না; চিন্ময় রাজ্যে ডুবে থাকতে থাকতে শরীর ও মন চিন্ময়ত্ব প্রাপ্ত হবে । এই খেলা স্বয়ং ভগবানই খেলছেন।”
“মানুষ যতই বাইরের উপদেশ গ্রহণ করুক, শেষ পর্যন্ত নিজের মনের অন্তরতম প্রদেশ থেকে যে আদেশ ধ্বনিত হয়, তাই যেন সকলের চেয়ে বড় হয়ে ওঠে। যখন মনের বাণী ও গুরুর আদেশ বাক্য একই হয়ে দাঁড়ায়, তখন আর দ্বিধা থাকে না এবং মন ও প্রাণ এক করে কাজ করার সুবিধা ঘটে।….মানুষ যদি নিজের ভেতর থেকে প্রেরণা না পায় তা হলে তার আর কোনো কাজে উৎসাহ থাকে না।”
“যাঁরা শক্তিপথ ধরে চলেন, তাঁরা কাম ও অজ্ঞানতা, ভালবাসা ও মৃত্যুভয়……প্রেম ও জ্ঞান যুগপৎ একসঙ্গে অনুভব করতে করতে শক্তির কেন্দ্র স্থানে উপনীত হন। সেই কেন্দ্রের স্পন্দন এত দ্রুত যে মনে হয় যেন তা স্পন্দনহীন। সাধক সেই অতিমাত্র স্পন্দনে যা স্পন্দনহীন ভাবের মধ্যে ডুবে পরমব্রহ্মে এমনভাবে ডুবে যান যে, তার ফলে কোনো প্রকার বোধই তাঁর মধ্যে থাকে না। তখন পরমপুরষের হাতের পুতুল হয়ে তাঁর ইচ্ছামতো কার্য করতে থাকেন, তিনি দেখতে পান, সমস্তই ব্রহ্মের বিকাশ বা বিলাস লীলা; তিনিই স্বয়ং অনন্ত কোটি ভাবে অসংখ্য আধারের মধ্য দিয়ে লীলা করে চলেছেন।”
“জাগতিক জ্ঞান ও অজ্ঞান এমনভাবে যুক্ত যে একটিকে বাদ দিয়ে আর একটিকে আমরা ধারণাই করতে পারি না।…..(যথার্থ সাধনার মাধ্যমে ক্রমেই) মনে ত্রিগুণের সাম্যাবস্থার পরিণতি হতে হতে মন ক্রমে জ্ঞান ও অজ্ঞানের সীমারেখা অতিক্রম করে যায়। (তারপর আর) কোনো কিছুতেই সে মন চঞ্চল হয়ে ওঠে না।…. সাধকের চেতনাকে ছাপিয়ে, (অহং) অস্তিত্বকে ডুবিয়ে যতই, ‘আমি জ্ঞান ও প্রেমরূপে বিকাশমান আছি’ এই সত্যটি প্রধান হয়ে উঠতে থাকে, ততই (অহংবোধক) ‘আমি’র অস্তিত্ব তলিয়ে যেতে থাকে এবং স্বয়ং প্রকাশ জ্ঞান ও প্রেম যেন ‘আমি’র আবেষ্টন থেকে মুক্তি পেয়ে নিরবলম্ব নিরপেক্ষ সত্যের সঙ্গে একাকার হয়ে যায় ।…… তখনই অনন্ত কৃপাময়ের কৃপায় হয় ‘তুমি’র বিকাশ, অথবা ‘আমি-তুমি’র দ্বৈতভাব ঘুচে জ্যোতিময় সত্তার বিকাশ।… ক্রমশঃ এক চিন্ময় রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় মানব মন। সমস্ত পরিব্যাপ্ত করে সকল সুর, ভাব, কর্ম, সমস্যা, সন্দেহ, প্রশ্ন, কর্তব্যকে ছাপিয়ে একটি মাত্র অনাদি অনন্ত ‘কেবল’ এর অনুভূতিই সমসুরে, সমতালে, সমলয়ে সাধকের উপলব্ধ হয় ৷”
“শক্তিপথ ধরে যে সাধক উঠতে থাকেন, তিনি সুষুম্না পথে যোগ ও ভোগ একত্রে অনুভব করতে করতে ক্রমশঃ জ্ঞান ও প্রেম উপলব্ধি করে নির্বিকল্প সমাধি লাভ করে ধন্য হন।”
“নিজের কৃতিত্বে আস্থাবান হলেই জমার ঘর শূন্য। সামান্য একটু শক্তি লাভ করে এবং দু-দশ জনের কাছে প্রতিষ্ঠা লাভ করে অনেক সাধকের মনে অহংকারের উদয় হয়। তখন তার কাছে….বড় হয়ে ওঠে অধিকতর খ্যাতির লালসা……খ্যাতি আসে আসুক। নিজ শক্তির দিকে দৃষ্টি দেবে না। আত্মশক্তির পেছনে যতদিন সর্ব শক্তিমানের হাতখানি সাধক না দেখে, ততদিন তার পথ নিষ্কন্টক নির্বিঘ্ন হয় না।….সর্বদা বিচার বুদ্ধি ও বিবেককে জাগ্রত রাখতে হয়। যা না বললে নয়, না করলে নয়, ততটুকুই বলা ও করা সঙ্গত।….প্রকৃত উদ্দেশ্যে সজাগ থেকে অবিচলিত ভাবে কাজ করাই প্রকৃত মঙ্গলের পথ।”
“যদি কেউ ঐকান্তিক ভাবে বিশ্বাস করেন যে, ভগবানই সকল কার্য নিজে করছেন, তখন অবশ্য তাঁর আর কিছু করণীয় থাকে না। তিনি তখন সাধনার অতীত মহা-পুরুষ। নতুবা “আমাদের সকল কার্য নিজেরাই করি”-এই বিশ্বাস যারা করে তাদের সাধনাভ্যাস করা বিশেষ প্রয়োজনীয়।”