বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী ১৮৪১ সালের আগস্ট মাসে বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নদীয়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ইনি যেতিয়া বাবা, অচ্যুতানন্দ পরমহংস, গোসাঁইজি নামেও পরিচিত। হিন্দু সমাজের কুসংস্কার দূরীকরণে এনার যথেষ্ট অবদান ছিল। ইনি ভক্তিযোগ এবং অচিন্ত্য ভেদা অভেদে বিশ্বাসী একজন ব্যক্তি ছিলেন। অবশেষে ইনি ১৮৯৯ সালের জুন মাসে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের পুরীতে মারা যান। এনার (Bijoy Krishna Goswami Quotes) কিছু উপদেশ নিছে উল্লেখ করা হলো।-
“একটি কাজ নিতান্ত অনিচ্ছা থাকলেও এবং পুনঃ পুনঃ বিরত হতে চেষ্টা করেও যখন অবশ হয়ে তা করে ফেলো, তখন তা প্রারব্ধবশতঃই হলো জানবে।অনিচ্ছাসত্ত্বেও যখন কোনো কাজে প্রবৃত্ত হতে হয় জানবে, ওই কর্ম ‘প্রারব্ধ’।”
“বৈধভাবে …. ইন্দ্রিয় চরিতার্থ করে নাও…..তবে তো ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে। ‘কাম’ নষ্ট হোক । ..একথা ঠিক-না। কাম থাকুক, কিন্তু (আত্মবোধ থাকুক ত্রিগুণাতীত’ হয়ে। এই কামই উপাসনা ভজন, যা কিছু ; তখন তার নাম প্রেম।”
“কর্তৃত্বাভিমান না গেলে মানুষ মুক্ত হয় না।… ভগবানই সর্বময় কর্তা। তাঁর অজ্ঞাতসারে বা তাঁর ইচ্ছা না হলে একটি তৃণও নড়ে না। কর্তৃত্বাভিমান যতকাল আছে, ততকাল তাপও আছে। কৰ্তৃত্বাভিমান না থাকলে কোনো তাপই স্পর্শ করে না। … তিনিই সব করেছেন, তিনি সমস্ত করিয়ে নিচ্ছেন— এটি বুঝলেই শান্তি।”
“মহাপুরুষদের কথা তো শাস্ত্র বিরুদ্ধ হয় না, তবে শাস্ত্রের সাধারণ ব্যবস্থার সঙ্গে মিল নাও হতে পারে। বিশেষ বিশেষ অবস্থায়, –এ তো বিশেষ বিশেষ ব্যবস্থা শাস্ত্রেই আছে।”
“যথার্থ সত্যলাভ করতে হলে সকল প্রকার সংস্কার বর্জিত হতে হয়। সংস্কার সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ হলে মনটি একেবারে নির্মল হয়ে যায়। যাঁরা কোনো মতামতের বা সংস্কারের অধীন না হয়ে কেবলমাত্র নিজের অন্তরে সতেরই অনুসন্ধান করেন, তাঁদের কোনো দলও নেই: সম্প্রদায়ও নেই।”
“সমস্ত জীব কেবল (কায়িক) উপাধিতে আবৃত বলে (স্বরূপে) অন্ধবৎ আছে। উপাধি যত কাটে, ততই দেবত্ব লাভ করে, এই জন্য জীবকে “চিৎ-কন” বলেছে। জীবন (উপাধি) মুক্ত হলেই ‘শিব’ (স্বরূপ)।”
“ভগবান ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিবরূপে যেমন কায়িক সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয়ের কর্তা হয়ে আছেন, সেইরূপে অপ্রাকৃত বৈকুণ্ঠ— শিবলোকাদি ধামেও তাঁর ওই প্রকার সচ্চিদানন্দ রূপ আছে। ভগবানই এক এক রূপে ভক্তের নিকট লীলা করেন।”
“মানুষের মনুষ্যত্বকেই মানবীয় ধর্ম বলে। প্রত্যেক মানুষ সাধনা করলে এই মানবীয় ধর্ম অতিক্রম করে ‘দেবত্ব’ লাভ করে। এই দেবত্ব থেকে উন্নত হলে (মানুষ) জীবাত্মা পরব্রহ্মের অসীম সত্তায় প্রবেশ করে লীলারস সম্ভোগ করে।”
“ভগবানের পদাশ্রিত ভগবৎ— জন মহাপুরুষেরাই সদগুরু। ‘অন্নময়কোষ’ ভেদ হলে পার্থিব বস্তুতে আকর্ষণ থাকে না। ‘প্রাণময় কোষ’ ভেদে শারীরিক উত্তেজনা (আর) থাকে না। ‘মনোময়কোষ’ ভেদে সঙ্কল্প-বিকল্প যায়। ‘বিজ্ঞানময় কোষ’ ভেদে সংশয় বুদ্ধি থাকে না। ‘আনন্দময়কোষ’ ভেদে পার্থিব আনন্দে (আর) মুগ্ধ করতে পারে না। তত্ত্বজ্ঞানের উদয়ে “মোহ” নষ্ট হয়।”
“পাপ-পূণ্য সবেরই একটা স্বরূপ আছে, সেটি দর্শন হলেই লোকে ঠিক বুঝতে পারে। এখন যা পাপ পূণ্য মনে করছো, সমস্তই একটা সংস্কারমাত্র ।”
“জ্ঞান ও ভক্তি উভয়ই প্রয়োজন। জ্ঞান না হলে ভক্তি প্রকাশ হয় না। কারণ যাঁকে ভক্তি করবো, তাঁর বিষয়ে না জানলে কাকে ভক্তি করবো ?”
“সদ্গুরু প্রদত্ত নাম, অক্ষর নয় বা একটা শব্দ নয়। এই নামেই অনন্ত শক্তি। শিষ্যের ভেতরে এই শক্তি সঞ্চারই সদ্গুরুর দীক্ষা। ঈশ্বরের শক্তি সকলের মধ্যেই আছে। একটি মহাপুরুষের শক্তি দ্বারা সেই শক্তিকে, জাগরিত করে দেওয়াকেই শক্তিসঞ্চার বলে।”
“জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলন হলে তখন আত্মা নিজেকে স্বতন্ত্রবোধে ধারণা করা ভুলে যায়, যা দেখে ব্রহ্মসত্তাই দেখে। ..অন্যেরা ভাবে সে ভগবানের সঙ্গে মিলে গেছে, কিন্তু তখনো তার পার্থক্যবোধ থাকে, – ভগবানের রসলীলা দেখতে থাকে ও ধন্য হয়।”
“সকলের পক্ষে এক ব্যবস্থা নয়। মানুষের সঙ্গে ব্যবহার, প্রকৃতি বুঝে করতে হয়। অন্যের মতের সঙ্গে অনৈক্য বা অবস্থার সঙ্গে অমিল হলেই তা একেবারে উড়িয়ে দিতে নেই। ভগবানের রাজ্যে কোনো দুইটি বস্তু ঠিক এক মতো নয়, কোনও না কোনো অংশে কিছু পার্থক্য থাকবেই।”
” ‘আমার উন্নতি আমিই করতে পারি’– এই অভিমানটি থাকতে মানুষ ভগবানের দিকে তাকায় না। তাঁর কৃপা ব্যতীত যে কিছুই হবে না। এটি পরিষ্কার রূপে বুঝবার জন্যই সাধন ভজন ।”
“দুটি ইন্দ্রিয় প্রবল জিহ্বা ও উপস্থ যৌনেন্দ্রিয়। উপস্থ লোকে দমন করতে পারে। কিন্তু জিহ্বাকে সহজে বশে আনা যায় না। জিহ্বাকে বশে রাখলে সমস্তই বশ হয়। কথা যত সংযত করতে পারবে, মনে ততই শান্তিলাভ করতে পারবে।”
“যথার্থ যোগ সাধিত হলে ভগবান কীরূপে জগতে বিরাজ করেন তা প্রত্যক্ষ হয়।”
“ ‘নিজের কোনো ক্ষমতা নেই” বুঝলে তাঁর ওপর নির্ভর না করে আর উপায় কী? যখন দেখবে কোনো দিকেই বাসনা নেই, বিষয়ের সংশ্রবেও ইন্দ্রিয় সকল সম্পূর্ণ অনাসক্ত, নিবৃত্ত, তখনই বুঝবে ‘এখন কর্ম শেষ হয়েছে।”
“সকল অবস্থাতেই ধর্ম, ধৈর্য, বিনয় ও মিত্রতা ঠিক থাকলে যথার্থ ধর্মলাভ হয়েছে বুঝবে। বিপদে আপদে, নিন্দাতে – প্রশংসাতে মানুষের যথার্থ ধর্মলাভ হয়েছে কিনা পরীক্ষা হয়।”
“ধর্মজীবন (আচরণ) না হলে, অনুষ্ঠানের কোনো মূল্য নেই। গঙ্গাস্নান করছে, মালাজপ প্রভৃতি অনুষ্ঠান করছে, অথচ প্রাণে নিষ্ঠা আসছে না; তাতে ফল কী? ধর্ম বাইরের বস্তু নয়।”
“মুক্ত পুরুষকে সহজে চিনতে পারা যায় না, তাঁদের ভাব ও ভাষা অত্যন্ত গভীর।….। (অনেকেই) ব্যবহারও অনেক সময় এমন করেন যে, সাধারণ তাতে প্রবেশ করতে- পারে না, সুতরাং (তখন তাদের) শ্রদ্ধাও হয় না।”
“ভালো না লাগলে নাম করবো না, যখন ভালো লাগবে তখন করবো -এ ভাব ব্যবসাদারী।—নাম করার সময় (যদি) মনটি নানাদিকে ঘুরে বেড়ায় হবে না। স্থির হয়ে করা চাই।”
“সকল দেশে, সকল সম্প্রদায়ে, ধর্মের বহির্ভাগ অর্থাৎ কর্মকাণ্ড নিয়ে দলাদলি। এই অবস্থা ভেদ করে প্রকৃত ধর্ম, যা জীবনে মরণে সহায়, তার প্রতি দৃষ্টি পড়লে, ধর্মের মতামত নিয়ে বিবাদ অনেক পরিমাণে চলে যাবে।”
“কোনো দলে বা সম্প্রদায়ে আবদ্ধ থাকবে না। কোনো সম্প্রদায়কেই অনাদর করবে না। —তিনি (অর্থাৎ ঈশ্বর) কোনো সাম্প্রদায়িক ধর্মের ভেতরে নেই। ‘আমার মতে না চললে কারোর কিছু হবে না।’— মনে করা অত্যন্ত ভুল।”
“যুক্তি ও আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে মিলিয়ে প্রত্যেক বিষয় গ্রহণ করা কর্তব্য। যাঁরা শাস্ত্রে বিশ্বাস করেন, তাঁদেরও যুক্তি ও আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে মিলিয়ে শাস্ত্র গ্রহণ করতে হবে— এটিও শাস্ত্রের উপদেশ।”
“নির্জনে বসে আত্মানুসন্ধান করে দেখবে দোষ আছে কি না। নিজের কাছে নিজে ভালো হলেই ভালো।”
“তোমার মনে যেমন ‘ভাব’ হবে, সেইরূপ বাক্যন্ত্রে শব্দ হবে। রাগ-রাগিণীর কোনো চাচা রূপ নেই, মনুষ্য মনের ভাবমাত্র। সেই ভাব মনে আসামাত্র নানা রাগ, রাগিণী কণ্ঠে বাজতে থাকবে। নিরাকার ভাব সাকার হয়ে ওই রূপে পরিণত হচ্ছে।”
“মহাপুরুষেরা কোনো প্রকারেও নিজেকে বড় বলে জানান না। সর্বদাই সন্তুষ্ট থাকেন, কখনো কোনো কারণে চঞ্চল হন না ……..ভেতরে অকর্তা, বাইরে কর্তা— মহাপুরুষের লক্ষণ। মুক্ত ব্যক্তিরা কর্মত্যাগ করেন না। অনাসক্ত হয়ে, বালকের ক্রীড়াবৎ, উন্মাদের নৃত্যবৎ তাঁরা সকল কার্যই করে যান। একটা (স্বয়ঃক্রিয়) যন্ত্রের মতো দেহ দ্বারা তাঁদের কার্যগুলি অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে মাত্র।”
“আত্মপ্রশংসা করো না, পরনিন্দা করো না। অহিংসা পরম ধর্ম। সর্বজীবে দয়া করো। শাস্ত্র ও মহাজনদের বিশ্বাস করো। শাস্ত্র ও মহাজনের আচারের সঙ্গে যা মিলবে না, তা বিষবৎ ত্যাগ করো।”
“বাস্তবিক সকলেই এক প্রকার হলে প্রকৃতির সৌন্দর্য থাকে না। নানাপ্রকার ফুলগাছে বাগানের যেমন একটা চমৎকার শোভা হয়, শুধু এক প্রকারের গাছে সে রকমটি কখনো হয় না। এ সংসারও সেইরূপ বিভিন্ন প্রকৃতির সমাবেশে এক সুন্দর শোভা ধারণ করেছে।
কোনো মানুষ যখন তা দেখতে পায় তখন সমস্ত বিরোধই ছুটে যায়। সে প্রকৃতির বিচিত্রতার ভেতর ভগবানের আশ্চর্য সৃষ্টি— শৃঙ্খলা ও অদ্ভূত কৌশল দেখে একেবারে মুগ্ধ হয়ে যায় ও পরমানন্দ লাভ করে, কিছুতেই আর বিচলিত হয় না। নিজের স্থানে নিজে ঠিক থেকে অন্যের অবস্থা দেখে যেতে হয়, তবেই ক্রমে শান্তি ।”
“ধর্মাভিমান বড়ই ভয়ানক, অন্যান্য অপরাধের পার, কিনারা আছে, কিন্তু ধর্মাভিমানীর পার সহজে নেই।”
“বাইরে অনেক পূজা, অর্চনা, জপ-তপ করেও যদি হিংসা থাকে, তা ধর্ম নয়। মারলেই যে হিংসা হয়, তা নয়। ক্রোধপূর্বক অথবা স্বকীয় তৃপ্তির জন্য বধ করলেও হিংসা হয় ।”
“ভগবানের ইচ্ছায় সব। ‘প্রারব্ধ’ কেবল ‘কথা’। ‘কর্ম’ কি ‘অদৃষ্ট’ কিছুই নয়। যিনি কর্তা, সমস্তই তাঁর ইচ্ছায় হচ্ছে। যখন যা প্রয়োজন ভগবৎ ইচ্ছাতেই সম্পন্ন হয়।”
“ধর্ম আংশিক কোনো অবস্থা নয়। চারদিকে দৃষ্টি থাকলে তবে ধর্ম হয়। সমাধিতে নিজের আত্মাতে পরমাত্মা যোগ হয় মূর্তিধ্যানে সমাধি হয় না, তা ধ্যানই।”
“ভগবানই সদ্গুরু। এক গুরুশক্তিই সমস্ত বিশ্বে ব্যাপ্ত হয়ে রয়েছে। যাতে ভগবানের চিত্তশক্তির বিলাস হয়, জ্ঞানশক্তির প্রকাশ হয় তিনিই গুরু।”
“নিঃস্বার্থ না হলে প্রকৃত (অর্থাৎ যোগমুক্ত) কর্মের আরম্ভ হয় না। জীবন্মুক্ত হলেই যথাই ‘কর্ম’ আরম্ভ।”
“নতুন মনুষ্য জন্ম যাদের, – তাদের অনেক জন্মের পর তত্ত্বজ্ঞানের বিকাশ হয়। বিষয়জ্ঞান প্রথম জন্ম থেকেই লাভ হতে থাকে। (জীব) চুরাশি লক্ষ প্রজাতি ভ্রমণ করে ‘মানুষ’ হয় । প্রারব্ধ সঞ্চিত, বর্তমান (ক্রিয়মান)— এই ত্রিবিধ কর্ম শেষ করতে অনেকবার জন্ম-মৃত্যু হয়। এইরূপ কর্মফল ভোগ করতে করতে ‘স্থূল’, ‘সূক্ষ্ম’ ‘কারণ’- এই ত্রিবিধ দেহ নষ্ট হয়ে ‘জীব’ মায়ামুক্ত হয়।”