ভূদেব মুখোপাধ্যায় ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ইনি ছিলেন একজন শিক্ষক, লেখক এবং শিক্ষাবিদ। ইনি ১৮৯৪ সালের মে মাসে কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। এনার কিছু উপরের নিচে উল্লেখ করা হলো।
“যে শক্তির প্রভাবে সমাজান্তর্গত পরিবারসমূহ পরস্পর সহানুভূতিসম্পন্ন এবং কিয়ৎপরিমাণে এক প্রাকৃতিক এবং একাকার হইয়া যায় তাহার নাম সামাজিকতা।”
“কন্যা অতি অল্প বয়সেই অন্যের যত্ন করিতে পারে। ফলকথা কন্যাসন্তানের অপেক্ষা পুত্রসন্তানের একটু বেশি যত্ন লইলেই যে উহাদের মধ্যে সাম্যভাব উদ্রেকের বিশেষ ব্যাঘাত হয় তাহা নহে।”
“ভারতবাসীর চলিত ভাষাগুলির মধ্যে হিন্দি হিন্দুস্থানীই প্রধান এবং মুসলমানদিগের – কল্যাণে উহা সমস্ত মহাদেশব্যাপক ; অতএব অনুমান করা যাইতে পারে যে উহাকে অবলম্বন করিয়াই কোনো দূরবর্তী ভবিষ্যৎকালে সমস্ত ভারতবর্ষের ভাষা সম্মিলিত থাকিবে।”
“জাতিভেদ প্রথা মুখ্যত বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে বিবাহ প্রতিষেধের জন্যই প্রবর্তিত এবং ক্রমে দৃঢ়ীভূত হইয়া আছে।—ভারতবর্ষে এইরূপ বিবাহ প্রতিষেধক বর্ণভেদ প্রথার নৈসর্গিক কারণ আছে।— দ্বিতীয়ত জাতিভেদ প্রচল্য থাকায় ধনের গৌরবটা অত্যন্ত বৃদ্ধি হইতে পায় না। জাতি ধর্মের আয়ত্ত নয়—তৃতীয়ত জাতিভেদ প্রচল্য থাকায় ভারতবর্ষের সমুদয় শিল্পকার্য বহু পূর্বকাল হইতেই অপরিসীম উৎকর্ষ লাভ করিয়া আছে।
—চতুর্থত মনুসংহিতার মতে “বৃত্তিকর্ষিত” হইলে একমাত্র ব্রাহ্মণের ব্যবসায় ভিন্ন অপর সকল ব্যবসায়ই সকলে অবলম্বন করিতে পারে। পঞ্চমত একমাত্র ব্রাহ্মণ বর্ণ ভিন্ন আর কাহারও অন্য বর্ণের লোকেরা আপনাদিগকে তেমন অপকৃষ্ট বলিয়া মনে করে না।— ষষ্ঠত জাতিভেদ প্রথা প্রত্যেক বর্ণের স্বাতন্ত্রিকতা স্থাপন করিয়া সকলেরই অনেকটা আত্মগৌরব রক্ষা করে।”
“পরীক্ষাবিধান ব্যতিরেকে বিজ্ঞানের শিক্ষা বিড়ম্বনা মাত্র। শিক্ষার অবস্থা এইরূপ হওয়াতে অধীত ইউরোপীয় বিজ্ঞানের সূত্রগুলি বার্ষিক পরীক্ষার সময় কন্ঠস্থ থাকিতে পারে, কিন্তু বৈজ্ঞানিক অন্তর্দৃষ্টি জন্মিতে পারে না। সর্বেশ্বর মতবাদে ঈশ্বর প্রত্যক্ষাদি সকল প্রমাণের দ্বারাই সুসিদ্ধ, যখন দেখা যাইতেছে, যে কারণের অনুসন্ধানে মনুষ্যমন চির জাগরূক, যখন দেখা যাইতেছে যে মনুষ্য সমাজের প্রতি সহানুভূতিমূলক যে ধর্ম তাহারও অতিব্যাপক পদার্থ, যাহা বিশ্বজ্ঞান এবং বিশ্বপ্রীতি এবং বিশ্বসৌন্দর্য প্রভৃতি অত্যুদার ভাবসকল মনুষ্যহৃদয়ে অধিষ্ঠিত
এবং যখন দেখা যাইতেছে যে সর্বজ্ঞত্ব, সর্বব্যাপকত্ব, সর্বশক্তিমত্তা অপাপবিদ্ধত্ব প্রভৃতি গুর্ণক্ষণে লক্ষিত মনুষ্যের উপাস্য বস্তু সর্বময় রূপেই বিদ্যমান, তখন পরস্পর হিংসাবিদ্বেষ—বিদূষিতাঙ্গ, আংশিক এবং কাল্পনিক একটি নারদের পূজায় মানববুদ্ধি এবং মানবহৃদয়ে তৃপ্ত হইবার সম্ভাবনা কোথা? আমার বোধ হয় যে, সর্বেশ্বরবাদই পৃথিবীতে ক্রমশ বিস্তৃত হইবে।”
“নেতৃ— মহাপুরুষের আবির্ভাব হইবে, ইহা সত্য। কিন্তু কোথায় হইবে, কখন হইবে, তাহা কোনো অনুমান করা যাইতে পারে না। অতএব সেই ঘটনা নিজের ঘরেই হইতে পারে, প্রতি ব্যক্তিকেই এরূপ মনে করিতে আপনার গৃহকে সর্বতোভাবে সেই আবির্ভাবোন্মুখ দেবতার পবিত্র মন্দিরের ন্যায় প্রতিষ্ঠিত করিয়া রাখিত হয়।”
“সাম্যবাদ হইতে সমাজের মধ্যে এক প্রকারের অসন্তোষ এবং অসুখের কারণ উপস্থিত হয়। মুখে যিনি যাহা বলুন, সামান্যতম মানুষ মানুষের অপেক্ষা বড় হইতে চায়। অতএব একপক্ষে সাম্যধর্ম পালন, পক্ষান্তরে অন্য মানুষ অপেক্ষা বড় হইবার প্রয়াস, এই দুয়ের সামঞ্জস্য ঘটিয়া উঠে না।”
“যে মনুষ্য সমাজ যত দিব্যভাবসম্পন্ন এবং সুশীল ও সভ্য হইবার জন্য যত্নশীল, সেই সমাজের মধ্যে লজ্জার তত আধিক্য দৃষ্ট হইয়া থাকে।”
“মনিব ধনশালী বলিয়া মানুষ, আর চাকর ধনহীন বলিয়া পশু হইতে পারে না। এমন স্থলে চাকর পশু হইলে মনিবও পশু হইবেন।”
“যাঁহারা ধর্ম শিক্ষা দিবেন, তাঁহারাই সকল শিখাইবেন ইহাই স্বভাবসিদ্ধ পদ্ধতি। পূর্বকালে ভারতবর্ষে ওই পদ্ধতি প্রচলিত ছিল, ব্রাহ্মণেরাই ধর্ম, বিজ্ঞান, শিল্প প্রভৃতি যাবতীয় বিষয়ের শিক্ষা প্রদান করিতেন। মুসলমানদিগের মধ্যে মুল্লা বা যাজকের দলই প্রধানত শিক্ষকতা কার্য করিয়া থাকেন। বৌদ্ধ জাতীয়দিগেরও ওই রীতি। অতএব যাহা পূর্বে ছিল এখনও আছে, তাহা পরেও থাকিবার সম্ভাবনা।”
“ভারতবাসীর যত প্রকার ত্রুটি দেখিতে পাওয়া যায়, সকলগুলিই সম্মিলন প্রবণতার ন্যূনতা হইতে সম্ভূত। ভারতবাসী রত্নপ্রসবা ভারতের ক্রোড়ে থাকিয়াও দরিদ্র। ভারতবাসী শ্রমশীল হইয়াও উদরান্নে বঞ্চিত। ভারতবাসী বুদ্ধিমান হইয়াও অন্যের পরিচালনা অপেক্ষী। ভারতবাসীর মৃত্যুভয় স্বল্প হইলেও তিনি ভীরু বলিয়া প্রসিদ্ধ। এই সকল এবং অপরাপর সকল দোষের একমাত্র মূল, সম্মিলনের অক্ষমতা।”
“জগতের কোথাও সাম্য নাই। গাছের একই ডালের দুইটি পাতাও পরস্পর সমান হয় না। একটি বালুকারেও অপর কোনো বালুকারেণুর সমান নয়। একটি বৃষ্টিবিন্দুও অপর বৃষ্টিবিন্দুর সমান নহে। জগতের সাদৃশ্য আছে, সাম্য নাই।”
“ভারতবর্ষীয়দিগের মধ্যে যে স্বভাবসিদ্ধ জাতীয় ভাব আছে, তাহার অনুশীলন এবং সম্বর্ধন চেষ্টা ভারতবর্ষীয় মাত্রেরই অবশ্য কর্তব্যকর্ম।”
“কুটুম্বকে অর্থলোভী জ্ঞান করিও না। তিনি তোমার গৌরবে আপনি গৌরবান্বিত হইতে চাহেন।”
“শাস্ত্র একবারও আমাদিগকে একান্ত “আলগা” হইয়া পড়িতে দেন না। যথোচিত কালে এবং যথাযোগ্য অবস্থায় আমাদিগকে আহার, বিহার, নিদ্রাদি, সেবন করিতে বিধি প্রদান করেন ; কিন্তু লোভ সুখেচ্ছা অথবা, আলস্যের বশীভূত হইয়া কিছু করিতে দেন না।”
“ধর্মের আদান-প্রদান হয়। অর্থাৎ যদি দুইটি জাতির ঘনিষ্ঠ মিশ্রণ ঘটে, তবে উভয়ের ধর্মও সম্মিলিত হইয়া একরূপ হইয়া যায়। রোমীয় এবং গ্রিকদিগের এবং অপরাপর দেবপূজাপরায়ণ জাতিদিগের মধ্যে এইরূপ হইয়াছে। কোথাও কোথাও দুইটি বিভিন্ন ধর্মের সংস্রবে একটি নূতন ধর্মের উৎপত্তি হয়। ভারতবর্ষের নানকপন্থী, কবীরপন্থী, গোরক্ষপন্থী, দাদুপন্থী প্রভৃতি পন্থী সকল মুসলমান এবং হিন্দু উভয় ধর্মের সম্মিলন সম্ভূত। অধিকতর বিদ্যাবুদ্ধিসম্পন্ন এবং সংখ্যায় বৃহত্তর জাতির সহিত সংস্রব ঘটিলে তাহার ধর্ম, অপেক্ষাকৃত স্বল্পজ্ঞ এবং ক্ষুদ্র জাতি কর্তৃক পরিগৃহীত হয়। সিংহল, ব্রহ্ম, তিব্বত দেশাদিতে বৌদ্ধধর্মের প্রচার।”
“মনুষ্য শিশুর পক্ষে পিতামাতাও যাহা, মনুষ্য সমাজের পক্ষে ধর্ম এবং ভাষাও তাহা, ধর্ম সমাজের পিতা, ধর্ম হইতে সমাজের জন্ম ও রক্ষা, আর ভাষা সমাজের মাতা, ভাষা হইতে সমাজের স্থিতি এবং পুষ্টি হয়। ধন বল, দলবন্ধন বল, বাণিজ্য বল, আর রাজনৈতিক স্বাধীনতা বল, সকল দিয়াও সমাজ বাঁচিয়া থাকিতে পারে ; কিন্তু যে সকল লোকের ধর্ম এবং ভাষা গিয়াছে, সে সকল লোকের স্বতন্ত্র সমাজ আছে, এমন কথা বলা যায় না।”
“মনোবৃত্তি মাত্রেরই কারণ শক্তির নাম স্মৃতি—অর্থাৎ স্মৃতিকে অবলম্বন করিয়াই সকল মনোবৃত্তি কার্যকারিণী হয়।”
“স্থূল কথা এবং সূক্ষ্মকথাও এই যে শাসনের প্রয়োজন কখনোই যাইতে পারে না, তবে শাসন কঠোর না হইয়া অর্থাৎ দণ্ডমূলক না হইয়া অধিক পরিমাণেই শিক্ষা এবং উপদেশমূলক হইতে পারে। আর সমাজ হইতে বৈষম্য যাইতে পারে না, কিন্তু উহার অনেকটা ন্যূনতা হইতে পারে। সুতরাং ইউরোপীয় সমাজ—বিপ্লাত্বকবর্গের ধ্বনিত ‘স্বাধীনতার’ পরিবর্তে “শাস্ত্রাধীনতার” এবং সাম্যের পরিবর্তে ‘ন্যায়ানুগামিতার’ এবং ভ্রাতৃত্বের পরিবর্তে “ভক্তি, প্রেম এবং দয়া”র ধ্বনি উত্থিত হইলেই ভালো হয়।”
“তোমার আমার বিবাদ না হয় এরূপ করিতে হইলে, হয় তুমি যাহা চাও, তাহা আমি না চাই। অথবা উভয়ে যাহা চাই সেই বস্তুর পরিমাণ বৃদ্ধি হইয়া উঠে। মনে হইতে পারে যে, প্রথমটি পরার্থপরতা বুদ্ধির প্রাবল্যে সাধিত হইবে, দ্বিতীয়টিও বৈজ্ঞানিক অবিস্ক্রিয়ার প্রভাবে সম্পাদিত হইবে। কিন্তু পরার্থপরতাও অসীম হইতে পারে না, আর বিজ্ঞান যতই বিকলন শক্তির আস্ফালন করুন, এ পর্যন্ত একটিও প্রকৃত নূতন দ্রব্যের সংকলন করিতে পারেন নাই।
সুতরাং যেমন ব্যক্তিগত বিবাদ-বিসম্বাদের মীমাংসা রাজ্যব্যবস্থার বলে সাধিত হইয়াছে, জাতিগত বিবাদের মীমাংসাও যদি কখনো বিনা যুদ্ধে সিদ্ধ হয়, তাই সেইরূপ হইতে পারে।— অর্থাৎ বিভিন্ন জাতীয় লোকদিগের মধ্যে সকলের মাননীয় এমন একটি সভার সংস্থাপন হইতে পারে, যে সভা বিভিন্ন জাতির বিবাদের হেতু জানিয়া বিনা যুদ্ধে বিবাদের মীমাংসা করিয়া দিতে পারিবেন। কিন্তু যুদ্ধের মূল কারণ কিছুতেই যাইবার নহে ।”
“অনুকরণ বাহ্য, উদ্ভাবন আভ্যন্তরিক। অনুকরণে ভেদবুদ্ধির প্রাবল্য, উদ্ভাবনে একত্ব এবং তদাত্মতা। এইজন্যই যিনি অনুকরণ করিতে পারেন, তিনি প্রায়ই উদ্ভাবন করিতে অসমর্থ হয়েন।”
“শাস্ত্রের অভিপ্রায়, মানুষ আপন উদ্দেশ্যের স্থিরতা, মনোযোগের ঐকান্তিকতা, চিত্তের প্রশস্ততা, এবং শরীরেই পটুতা সম্বর্ধন সহকারে সকল কাজ করে না।”