ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ১৮৯৪ সালের ডিসেম্বর মাসে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের শ্রীরামপুরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি একদিকে ছিলেন যেমন সমাজ বিজ্ঞানী অপরদিকে তিনি মার্কসবাদী ছিলেন। তিনি কলেজেতে উদযাপনের কাজও করেছিলেন। অবশেষে তিনি ১৯৬১ সালের ডিসেম্বর মাসে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। এনার কিছু বানী নিচে উল্লেখ করা হলো। –
“শৈশব অবস্থায় ভিরু, যৌবন অবস্থায় কাজ- বাগানো ছেলে, বগুড়া অবস্থায় সাকসেসফুল ম্যান হওয়া সাধনার, শিক্ষার উদ্দেশ্যে হলে, সত্য কথা কওয়া, সত্য আচরণ করা অসম্ভব হয়ে ওঠে।”
“আজকালের সাহিত্য বড্ড অ্যারিস্টোক্রেটিক ব্যাপার হয়ে উঠেছে। সেটা ভালো লক্ষণ নয়, কেননা সেই সাহিত্যই সত্যিকারের সাহিত্য, যেটা মানুষের বুকের ওপর গড়ে ওঠে।”
“একবারে বিদেশি বুলির চাপ, অন্যধরে হৃদয়বৃত্তি চর্চার অসুবিধা- এই দুইয়ে মিলে আমাদের দেশের বুদ্ধিমান যুবক প্রথমেই স্ত্রীর সঙ্গে প্রেমে হাবুডুবু খায়, তারপর যখন চোখ খোলে তখন দেখতে পাই সে জীবনটা বরবাদ হয়ে গিয়েছে। নতুন করে প্রেমে পড়বার সুযোগ নেই। থাকলেও ধর্মে বাধে- কেননা স্ত্রী হলেন ধর্মপত্নী, পুরুষদের বেলায় যদি এ কথা একগুণ সত্যি, মেয়েদের বেলায় হাজার গুণ। বুদ্ধিমান লোক অসুখী হয় বলেছিলাম এই ভেবে যে, তাদের চোখ একবার না একবার খোলে। অন্য সম্প্রদায়ের চোখ কখনো খোলে না এবং তারাই সুখী, তারাই সমাজের স্তম্ভস্বরূপ।”
“গানও ভাষা কবিতাও ভাষা। তবে রাগ, লোভ, মোহ, প্রেম প্রভৃতি মনোভাবকে প্রকাশ করতে গান মোটেও ব্যস্ত নয়। সাহিত্যের কারবার ওইসব নিয়ে। চোর অত্যন্ত অবাস্তব জিনিস, সুরের রাজত্বে ‘মন হার মেনে যে কাঁদে’।”
“সত্যিকারের যোগী কালাতীত হবার জন্য সাধনা করেন শোনা যায়। তিনিও ইতিহাসের হাত থেকে ইতিহাস সম্বন্ধে মতামত গড়ে তোলার প্রয়োজন থেকে পরিত্রাণ পেয়েছেন বলে মনে হয় না। যোগী সমগ্র বিশ্বের কল্যাণ চিন্তায় নিযুক্ত থাকেন, বিশ্বের অকল্যাণ হয়েছে, অকল্যানের পথে অগ্রসর হচ্ছে, না ভাবলে কল্যান চিন্তার প্রয়োজনই থাকে না।”
“সমাজের সভ্যতা, ব্যক্তির বৈদস্ক্য। বৈদগ্ধ্য পরিবর্তন, অগ্রসৃতি এবং প্রগতির মূলগতি। সভ্যতা সেই গতির রুদ্ধ অবস্থা চরম অবস্থা, অর্থাৎ মৃত্যু। বৈদগ্ধ্য আত্মার বিকাশ। বুদ্ধির দ্বারা সেই বিকাশকে নিয়মে গ্রথিত করে বোঝবার প্রয়াসকে সভ্যতা বলা যেতে পারে। বৈদগ্ধ্যে উপনিষদ, সভ্যতায় টীকাভাষ্য। একটিতে মানুষ মন্ত্রদ্রষ্টা, ঋষি, আর্টিস্ট, সম্পূর্ণ মানুষ, অন্যটিতে মানুষ কলের কুলি, যজ্ঞের পুরোহিত, স্কুল মাস্টার এবং সাহিত্য ক্ষেত্রের সমালোচক ও প্রবন্ধ লেখক।”
ধ্বংসের কারণ ভগবানের ইচ্ছা সাপেক্ষ নয়। তার কারণ ধনতন্ত্র মূলক সমাজের প্রতিপত্তিশীল শ্রেণীর তদবস্থস্থিতি প্রবণতা এবং বিজ্ঞানের কৃপায় নব নব উপায়ে উৎপাদনের প্রাচুর্য। এই সামাজিক জীবনের স্থিতি, প্রগতি ও অবনীতির ব্যাখ্যা হওয়া উচিত বৈজ্ঞানিক উপায়ে।- অর্থাৎ মানুষ তার সমবেত চাহিদা ও প্রচেষ্টার ফলে যে উপায়ে বহিঃপ্রকৃতিকে জয় করেছে কিংবা চেষ্টা করছে জয় করতে তারই ইতিহাসের সাহায্যে।”
“সভ্যজগতে ইতিহাস সম্বন্ধে মতামত গড়ে তোলবার একটা বিশেষ প্রয়োজন সর্বদাই। ঘটনার পারম্পর্য কিংবা বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে সেই মতামতের সংস্পর্শে। নচেৎ মানুষ ঘটনাস্রোতে খড়কুটোর মতন ভেসেই চলে, জীবনের কোনো অর্থ ও সার্থকতা থাকে না।”
“সমাজ ও ধর্মের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তি সূক্ষ্মপুরুষটি না বদলালেও তার মানসিক অভ্যাসগুলি বদলে যাচ্ছে। সেই পরিবর্তনের বিবরণ চাই। সেই বিবরণই সাহিত্যের বিষয়বস্তু হবে।”
“মানুষের স্বভাব বলে কোনো অপরিবর্তনীয় বস্তু নেই। সে স্বভাব কোথায় যেন বদলাচ্ছে। কোনো রন্ধ্র দিয়ে হাওয়া প্রবেশ করে ‘ছোটো আমি’র বন্ধ ঘরের বদ্ হাওয়াকে তাড়িয়ে দিচ্ছে।”
“বক্তৃতার সুবিধা দেখুন, হাতে রইল নোট, মাথায় রইল পয়েন্ট, পয়েন্ট ঠিক থাকলে বক্তব্যটি নিজের লাইন ধরে স্টেশনে এসে পৌঁছবে রাস্তায় মালগাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লাগবে না।”
“ভয় ছেলেমেয়েদের শেখানো হয়। সে শিক্ষার জন্যে বাপ-মা’ই দায়ী, শৈশবস্থায় মা ও ঠাকুরমার দল, যৌবনাবস্থায় পিতা ও পিতৃস্থানীয়েরা অর্থাৎ শিক্ষক, অভিভাবক দল।… সত্যকথন, সত্য আচরণ অন্যায়, অবশ্য এ কথা তাঁরা শেখান না। মুখে, কিংবা বিদ্যাসাগর মশাই-এর মুখ দিয়ে তাঁরা সত্যের মাহাত্ম্যই প্রচার করেন। কিন্তু শিশুরা বালক-বালিকারা ভারি চালাক—তারা ঘোর রিয়ালিস্ট। বাপ-মায়ের জুয়োচুরি ধরতে তারা ওস্তাদ। বাপ-মায়ের মনের কথাটি তারা তাঁদের আচরণের বুক আঁচড়েই বুঝে নেয়। ‘বিপদের সময় মুখ বন্ধ করাই সমীচীন, গা ঢাকা দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ’—এ ধরনের দৃষ্টান্তমূলক শিক্ষা তাঁরা সদা-সর্বদাই দিয়ে থাকেন।”
“কল যেমন থামে না, বিজ্ঞানও তেমনি থামে না।”
“চঞ্চলতা একটি পাপ নয়, ওটা বুদ্ধির গোড়ার কথা। চঞ্চলতা ক্ষণস্থায়ী বলেই তাকে অশ্রদ্ধা করা যায় না।”
“সমগ্র সভ্যতার মাপকাঠি এই বৈঠকখানা সাজানো, তার আকার-প্রকার এবং অন্তঃপুর থেকে দূরত্বের ওপর নির্ভর করছে। আমাদের মনের সংস্কার বদলাচ্ছে—সেইপরিবর্তনের ফলেও সঙ্গে সঙ্গে বৈঠকখানার চেহারাও বদলাচ্ছে।”
“ব্যক্তিত্ববাদের মূল কথা আর্থিক উন্নতির সাধনা। পুরুষাবাদের তত্ত্বকথা বর্ণাশ্রম, অর্থাৎ সমাজের ভেতরে বিকশিত হবার পর, গুটিপোকার মতন কেটে বেরোনো। মার্কসবাদ আর হিন্দুত্ব এক বস্তু বলছি না, আমার বক্তব্য এই যে, ব্যক্তিত্বের নামে মার্কসবাদের বিচার করা ভারতবাসীর মুখে মানায় না। মানায় ভারতীয় ধনিকদের এবং ইংরেজি শিক্ষিত সম্প্রদায়ের। মার্কসবাদের অন্য গলদ থাকতে পারে; তবে ব্যক্তিত্ব নামক কল্পিত বস্তুর বিশেষ রকমের উন্নতি বিধানের স্থান, কিংবা জল্পনা,কল্পনা মার্কসবাদে নেই বলে তার সমালোচনা চলে না, কারণ তা হলে সমগ্র মানব প্রচেষ্টার গতির বিপক্ষে যেতে হয়, জ্ঞানের ইতিহাসকে অপমান করা হয়।”
“প্রগতি বলতে আদর্শ কিংবা প্রেরণা অনুসারে অগ্রসর হওয়া বুঝি।”
“বুদ্ধি দিয়ে আদর্শ সৃজন করলে মানুষ কর্তৃত্ব করবার আত্মপ্রসাদ উপভোগ করতে পারে, কিন্তু জীবনটা হয় কল। খানিকটা জীব—কিন্তু গোটা জীবন তারও অতিরিক্ত একটি অখণ্ড শক্তি। এই শক্তি আত্মার। আত্মশক্তি, আত্মোপলব্ধির, আত্মানুভূতির ফল। উন্নতি মানে মানুষের আত্মশক্তির বিকাশ।”
“বুদ্ধি দিয়ে রসভোগ হয় না, রসভোগের জন্যে আর একটা আস্ত, বড় জিনিসের দরকার— সেটা বুদ্ধির বড়, প্রাণের বড়। এমনকি উপভোগ করবার ইচ্ছাশক্তিরচেয়েও বড়; অথচ সব মিলিয়ে একটা, সেটা আমার মধ্যে রয়েছে, অথচ আমাকে নিয়ে রয়েছে। তার নাম কি Personality?”
“বাঁচবার প্রধান উপায়ের নাম বিজ্ঞান।”
“প্রত্যেক আর্টিস্টই এই ব্যবহারিক জগতের উৎপন্ন মানসিক অবস্থাকে spring board- এর মতন ব্যবহার করেন—তাকে ঠেলে ‘জয় মা’ বলে আকাশে ঝাঁপ দেন।”
“শিক্ষাপদ্ধতি রইল সেই মধ্যযুগের, রক্ত ও বীজ রইল আদিম যুগের পরে চেষ্টা হল স্বাধীন হবার। পরিণাম দেশাত্মবোধ। কেননা সে স্বাধীনতা মানুষের নয়, দেশেরঅর্থাৎ শক্তিশালী দেশের দুর্বল দেশকে গ্রাস করবার অবাধ স্বাধীনতা আর গরিবের ওপর বড়োলোকদের অত্যাচার করবার অবাধ সুবিধে।”
“আর্টিস্ট ব্যবহারিক জগতের ধার ধারেন না, সাহিত্যিক একথা জেনেও জানেন না, কেননা, জানলে তাঁর চলে না, তাঁর লেখা লোককে বোঝাতেই হবে, সেই জন্যে ব্যবহারিক জগৎকে তাঁর একটু খোসামোদ করতে হয়। আর গায়ক—সে যখন তান তোলে তখন তার কাউকে সে তানের মানে বোঝাতে হয় না, সে জানেও না যে জগৎ আছে কি না, বোধহয় জগৎ তাকে বড় অবহেলা করেছে,এই জন্যেই সে জগতের কথা ভুলে গিয়েছে।”
“বক্তৃতার মধ্যে গোছানো কথা শুনতে গেলে শুদ্ধচিত্ত হওয়া চাই। শুদ্ধ চিত্ত মানে Tabularasa –মনটি পরিষ্কার শ্লেটের মতন হওয়া চাই, অর্থাৎ বক্তৃতার বিষয়সন্ধেও পূর্বে থেকে কোনো মতামত থাকবে না, মনে ভরে থাকবে শুধু বক্তারপ্রতি ভক্তি, বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা।”