শ্রীমৎ শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণব ১৮৬৯ সালে বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নদীয়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তুমি একদিকে ছিলেন যেমন সাধক ও অদ্বৈতবাদী তেমনি, অপরদিকে ছিলেন একজন বিশিষ্ট চিত্রনাট্যকার। অবশেষে ইনি ১৯১৪ সালে সে জীবন ত্যাগ করেন। উনার কিছু উপদেশ নিতে উল্লেখ করা হলো।
“সমস্ত মন্ত্রেই দুটি করে শক্তি নিহিত আছে, –বাচ্য ও বাচকশক্তি। যিনি মন্ত্রের প্রতিপাদ্য দেবতা তিনি বাচ্যশক্তি, আর যিনি মন্ত্রময়ী দেবতা তিনি বাচকশক্তি। বীজ যেমন ফলের অন্তর্নিহিত, বাচ্য শক্তিও তেমন বাচক শক্তির অন্তর্গত। বাইরের ফলাংশ ভেদ না করলে যেমন ভেতরের বীজাংশ লক্ষ হয় না, তেমনই বাচকশক্তির আরাধনা না করলে বাচ্যশক্তির স্বরূপ অনুভূত হতে পারে না। তাই এই দুই শক্তির কোনো একটিকে পরিত্যাগ করলে সিদ্ধি তো দূরের কথা মন্ত্রচৈতন্যেরও উপায় নেই।”
“চিদানন্দময় ব্রহ্মের প্রতি বিশ্বসমন্বিতা সত্ত্ব-রজো-তমো গুণময়ী প্রকৃতি দ্বিবিধা। যথা- বিশুদ্ধ সত্ত্বাত্মিকা প্রকৃতি (বিদ্যা) মায়া এবং অবিশুদ্ধ সত্ত্বাত্মিকা প্রকৃতি অবিদ্যা। তার মধ্যে (বিদ্যা) মায়াতে প্রতিফলিত ‘চিৎ’ প্রতিবিম্বের নাম ঈশ্বর এবং অবিদ্যাতে প্রতিফলিত ‘চিৎ’ প্রতিবিম্বের নাম জীব। (বিদ্যা) মায়ার স্বরূপ এক, সুতরাং তাতে প্রতিবিম্বিত ‘ঈশ্ব-র’ এরও ‘স্বভাব’ এক। নানা গুণময়ী অবিদ্যার স্বরূপ অনেক, সুতরাং তাতে প্রতিফলিত জীবের ‘স্বভাব’ অনেক। মায়া ঈশ্বরের অধীন, আর জীব
মায়ার অধীন।”
“নির্বাণ মুক্তি ভিন্ন জীবত্বের প্রকৃত মরণ নেই। (তা-ই জীবন্মুক্তি)। জগৎকে কি মগ্ন করেছেন।”
“বেদান্তদর্শনে অদ্বৈততত্ত্বের আবিষ্কার হয়েছে। তার সমন্বয় হয়েছে তন্ত্রশাস্ত্র। দ্বৈত (বোধক) জগতের মধ্যে দিয়ে অদ্বৈততত্ত্বে উপনীত হওয়ার জন্য তন্ত্র নিগূঢ় পথের আবিষ্কার করেছে; দ্বৈতকে অদ্বৈতে পরিণত করে আবার অদ্বৈত থেকে দ্বৈতলীলার অভিনয়ে ব্রহ্মানন্দ –রসস্রোতে জগৎকে জড় ও চৈতন্যের পরস্পর প্রেমালিঙ্গনে ।”
” ব্রহ্মত্ত্ব যিনি বুঝেছেন, তিনি নামরূপাত্মক এই ব্রহ্মাণ্ড রচনা দেখেই বিস্মিত হন না, অধিকন্তু ব্রহ্মময়ীর অনন্ত শক্তি দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে নাম-রূপ সব ভুলে গিয়ে প্রতি প্রকাশে সেই রূপ দেখতে থাকেন, যে রূপে এই বিশ্বরূপ ডুবে গিয়ে ব্রহ্ম-রূপের আবির্ভাব হয় ।”
“লৌকিক যুক্তির চাবি দিয়ে যদি পারমার্থিক তত্ত্বের তালা খুলতে যাও, স্বাভাবিক বুদ্ধি পর্যন্ত স্তম্ভিত হয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যাবে।….(সেনাপতি) মহারথীও যদি স্বয়ং নিরস্ত্র হন তবে তাঁর সমরোদ্যম যেমন ব্যর্থ হয়, মহাধীশক্তি-সম্পন্ন পণ্ডিতও তেমনই সাধন শক্তিহীন হলে তার পাণ্ডিত্য ব্যর্থ হয়।”
“দ্বৈততত্ত্ব নিয়েই ব্রহ্মময়ীর ব্রহ্মাণ্ডলীলা। … শক্তিতত্ত্বের প্রত্যক্ষ জ্ঞান হলে সাধক দেখেন, নিখিল বিশ্বসংসারে কেবল সেই বিশ্বেশ্বরীর বিচিত্র শক্তিবৈভব ভিন্ন আর কিছুই নয়। তখন দ্বৈত-জগৎকে আর (অদ্বৈত) সাধনার শত্রু বলে বোধ হবে না। সংসারই তখন সাধনার উপকরণময় সুপ্রশস্ত পবিত্র ক্ষেত্র বলে অনুভূত হবে।”
“সমস্ত মন্ত্রই নিখিল বর্ণধ্বনিময়ী পরমাত্মস্বরূপিনী কুমুণ্ডলিনীর স্বরূপ বিভূতি। সুতরাং সমস্ত মন্ত্রই বাঙ্ময় হলেও চিন্ময়স্বরূপ…..এমন কোনো সিদ্ধি জগতে নেই, যা মন্ত্রের সাধনায় লব্ধ না হয়। মন্ত্র সর্বমুক্তিময়, অর্থাৎ যার সাধনায় উপাস্য দেবতার সালোক্য সারূপ্য, সৃষ্টি, সাযুজ্য ও নির্বাণ—সাধক এর যে মুক্তিকেই প্রার্থনা করুক না কেন, কিছুই অসম্ভব নয়।”