শ্রীমৎ নগেন্দ্রনাথ ভাদুড়ী ১৮৪৬ সালের ডিসেম্বর মাসে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। নিয়ে একজন আধিকারিক মহাপুরুষ ছিলেন। ইনি আটটি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন এবং একজন বিশিষ্ট লেখকও ছিলেন। ১৮৮১ সালের দিকে ইনি সন্ন্যাস জীবন গ্রহণ করেছিলেন। অবশেষে ইনি ১৯২৬ সালের নভেম্বর মাসে শেষ জীবন ত্যাগ করেন। এনার কিছু উপদেশ নীচে উল্লেখ করা হলো।
“ব্রহ্মের দুটি লক্ষণ, স্বরূপ ও তটস্থ। স্বরূপে তিনি বাক্য ও মনের অতীত,…ভক্তের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করার এবং দুষ্টের দমন ইত্যাদির জন্য নিজের স্বরূপ ত্যাগ (আবৃত) করে….মনুষ্য রূপ ধারণপূর্বক মানুষের মধ্যে জ্ঞান ও ধর্ম প্রচার করেন। এই তটস্থ লক্ষণান্বিত ব্রহ্ম যখন জগতে নিজকর্ম সমাপন করে স্ব-ধামে যান, তখন পরবর্তী মানুষগণ তাঁর আকৃতি ও প্রকৃতি বিশিষ্ট মনোরম জড়প্রতিমা গঠন করে তাতে চৈতন্য আরোপ করে থাকে। একান্ত ভক্তের কাছে তিনি ধরা দেন।”
“সাধু সোজা না, সাধু হয়ো; সংসারী সেজো, সংসারী হয়ো না। সকাম ভক্তিই অনুশীলনের ফলে অহৈতুকী নিষ্কাম ভক্তিতে পরিণত হয়।”
“এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এক বিরাট রহস্য।…ক্ষুদ্র মানব তার অতি সীমিত বুদ্ধির দ্বারা শ্রীহরির বিচিত্র কার্যের কতটুকু উদ্ঘাটন করতে পারে ? …… সেই অঘটন-ঘটন পটীয়ানকে জানতে হলে তাঁর কার্যের দিকে লক্ষ্য করতে হয়……..তাঁকে শান্ত মনে প্রেমনয়নে দেখতে হয়।”
“আহার নিদ্রা-মৈথুন নিয়ে তো পশুপাখিও মত্ত থাকে, ভগবান মনুষ্য শরীর দিয়েছেন সাধনা করার জন্য। মন দিয়েছেন বিচার করার জন্য। সেই শরীরে সে যদি সাধন না করে, সেই মনে যদি বিচার না করে চলে তাহলে অশান্তি আসবেই। ভগবান কতো (প্রজাতির) জীব সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু সেই বিশ্বপিতা ভগবানকে ডাকবার শক্তি একমাত্র মানুষেরই আছে।”
“জড়ে সৃষ্টি করবে কীরূপে? ‘বুদ্ধি’ চাই তো, সুষ্ঠু বিন্যাস করতে ও সু-পরিচালনার জন্য। সেই বুদ্ধিমান সর্বজ্ঞ সর্বশক্তিমানই ঈশ্বর।…..প্রকৃতি তো জড় তার পক্ষে ইচ্ছাপূর্বক কিছু করা কি সম্ভব? নিশ্চয়ই সম্ভব নয়।….সেই কর্তা ভগবান।”
“মৈত্রী, করুণা, মুদিতা (অপরের সুখে সুখ হওয়া) উপেক্ষা—এই চারটিকে ব্যবহারিক জীবনে এমনকি আধ্যাত্মিক জীবনেও শান্তি পেতে হলে প্রতিক্ষণের সঙ্গী রাখতে হয়।”
” ‘তাঁর শক্তিতেই আমরা শক্তিমান। তাঁর কৃপাতেই আমাদের সব বাহাদুরী, এ-বুদ্ধি যতদিন না জাগে ততদিনই আমার শক্তি আছে’, ‘আমি করতে পারি’, ‘আমার করা উচিত’,—এই সব বোধ জাগে। যতদিন অহংকার থাকে, নির্ভরতা না জাগে, ততদিনই কর্তব্যবুদ্ধি থাকবে। ভেতরে প্রবৃত্তি থাকলে মন ছটফট্ করবে, আর বাইরে চুপচাপ থাকলে তা মিথ্যাচার হবে। আগে সার-অসার বিচার করে মনের প্রবৃত্তিকে শান্ত করেই বাইরের ইন্দ্রিয়গুলিকে শান্ত করতে হয়।”
“বিবেকের দৃষ্টিতে যা শ্রেয়ঃকর বোধ হবে, তাতে মনঃস্থির করার চেষ্টা একান্ত প্রয়োজন এবং তদতিরিক্ত সবই অসার অনিত্য অকল্যাণকর বলে (সেগুলির প্রতি আসক্তি) ত্যাগ করো। ….যদি তাঁর শরণাগত না হও, জগতে অনিত্য সুখের প্রতি আসক্ত হও…..তবে তো দুঃখ আসবেই।”
“ঐশ্বরিক ভালোবাসায় প্রতিষ্ঠিত হতে না পারলে বিশ্বজনীন ভালোবাসার উদয় হয় না ৷ সর্বভূতে যখন ঈশ্বর উপলব্ধি হয়, তখন মানুষ সবাইকে ভালো না বেসে থাকতে পারে না । এক প্রকার ‘বিশ্বপ্রেমিক’ আছে, যারা নাস্তিক সম্প্রদায়, তাদের এই বিশ্বপ্রেম থাকে না, যখনই স্বার্থে আঘাত লাগে, অপরকে ‘মারো মারো’ বলে।”
“অসতেরা সমাজে প্রতিষ্ঠা হারাবার ভয়ে ভণ্ডামির আশ্রয় নেয়, অন্যায় করে অন্যায়কে অন্যায় বলে মানতে চায় না।….. যদি সামান্য দোষ ত্রুটিও অঙ্কুরেই নাশ করো, আর প্রশ্রয় না দাও তোমাদের জীবন হবে শুচি-শুদ্ধ, হৃদয়ে সত্যস্বরূপের প্রকাশে জীবন হবে মধুময়।”
” হঠাৎ কিছু করতে গেলে (সাধন পথে) ভুল হবার সম্ভাবনা। সবদিকে সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে এগোতে থাকো, একদিন হবেই। কিছুই বিফলে যায় না। ধীরে চলো, মাটি কিন্তু দৃঢ়ভ কিন্তু দৃঢ়ভাবে, লক্ষ্য স্থির রেখে। তাহলে নিশ্চয়ই সিদ্ধিলাভ হবে।”
“অর্থের সাথে যদি ধর্মের যোগ না থাকে তাহলে সে অর্থ-প্রাচুর্য অর্থবানকে কু-পথে চালিত করে।….অর্থকে হাতে রাখবে, হৃদয়ে রাখবে না, পরমার্থকে হৃদয়ে স্থান দেবে।”
” মানুষের প্রত্যেকের সংস্কার পূর্ব-পূর্ব জন্মার্জিত।…মৃত্যুকালে যার যেমন চিন্তা গভীর ভাবে আশ্রয় করবে, জন্ম-জন্মান্তরের পরিপাক-উন্মুখ কর্মফল তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাকে তেমন শরীর ধারণ করাবে। তাই শুভ সংস্কার জাগাবার জন্য নিরন্তর স্বাধ্যায়, সাধুসঙ্গ, সাধনা করা প্রয়োজন ।”
“ধর্ম কি কারোর একচেটিয়া? গার্হস্থাশ্রমে থাকলে ধর্ম হবে না, সন্ন্যাসশ্রমেই হবে, -এরূপ কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই। তবে যেখানেই থাকো, বিষয় বাসনা ত্যাগ চাই, ঈশ্বর প্রাপ্তির জন্য একান্ত আগ্রহ জাগা চাই। …কায়মনোবাক্যে। ভগবানকে আশ্রয় করাই শারণাগতি।”
“মানস পূজাই বলো আর বাহ্য-পূজাই বলো, – সে সময় অন্য চিন্তা থাকলে, অনেকক্ষণ নির্জনে আসনে বসে থাকলেও কোনো সু-ফল হবে না। শুভ ভাবনা যতো বাড়াবে, অশুভ ভাবনা ততো সরে যাবে।”
” বৈচিত্র্য বা বৈষম্য না থাকলে কি লীলা আস্বাদন হয়? এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড-এ ভগবান বিচিত্র রূপে খেলছেন, কখনো দাতা-গ্রহীতা, কখনো শাসক-শাসিত, কখনো প্রতিপালক কত প্রতিপালিত আদিভাবে বিরাজ করছেন। যখন অহংকার ত্যাগ হয়, চোখের অজ্ঞান ঠুলী খুলে যায়, তখনই ধরা পড়ে।”