অশোক রুদ্র ১৯৩০ সালের নভেম্বর মাসে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বার্মাতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তুমি একদিন ছিলেন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ, লেখক। উনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইকোনমিক্সে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেছিলেন। অবশেষে ১৯৯২ সালের অক্টোবর মাসে ভারতের কলিকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ইনার কিছু উপদেশ নিচের উল্লেখ করা হলো।
“সংস্কৃতিকে স্পনসরেরা ব্যবহার করে, বিজ্ঞাপনের বাহনরূপে। তার কারণ বিজ্ঞাপনের.কাজটা অতিশয় জঘন্য। বিজ্ঞাপনের কাজ হল মানুষের মনে পণ্যের লালসাকে সুড়সুড়ি দিয়ে বাড়িয়ে তোলা, মিথ্যা বলে কোনো পণ্যের যে গুণ নেই সেই গুণ আরোপ করে তার প্রতি ক্রেতাদের মোহকে জাগ্রত করা।”
“গণ-আন্দোলনে কখনোই অংশগ্রহণ করা সম্ভব নয়, যদি আপনার মতো জনগণের সম্বন্ধে অশ্রদ্ধার ভাব মনে থাকে ।”
“অতীতের পুনর্মূল্যায়ন অবশ্যই প্রয়োজনীয়। কিন্তু অবৈজ্ঞানিক ও অনৈতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচারে বসে অতীতের সঙ্গে আমাদের বর্তমানকেও যেন দরিদ্রতর করে না ফেলি তা দেখাও আমাদের কর্তব্য।”
“বাঙালির অভ্যেস নেই আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে নিজের মুখ দেখা। সে অভ্যেস থাকলে তার নিজ সম্বন্ধেও ধারণা হয়তো কম ভ্রান্ত হতো।”
“ব্যক্তিত্বের পূর্ণবিকাশের জন্য বন্ধুত্ব ও প্রেম অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ এবং কোনো একজন পুরুষের (বা স্ত্রীর) পক্ষে কখনোই সম্ভব নয় আরেকজন ব্যক্তির যত প্রকার বন্ধুত্ব বা প্রেমের প্রয়োজন থাকতে পারে তা দেওয়া।”
“নরনারীর সম্পর্কে প্রেম নেই, বন্ধুত্ব নেই, যৌন আনন্দও অনুপস্থিত, এ সবেরই কারণ ঘুরে ফিরে একই। নারীদের সম্পর্কিত এক অত্যন্ত পরাক্রান্ত ভাবধারাকে সমাজের সকলে মেনে নিয়েছে যা, নারীপুরুষ নির্বিশেষে সকলকেই সার্থকতাহীন, প্রেমহীন, যৌন-আনন্দহীন জীবনযাপন করতে বাধ্য করছে। এই ভাবাদর্শ অনুযায়ী নারীরা দুর্বল, পুরুষেরা সবল। নারীদের স্থান ঘরে, পুরুষদের ভূমিকা বাইরে, নারীদের যে কোনো বিষয়েই প্রতিভা পুরুষদের চেয়ে কম—এক গৃহস্থালির কাজ বাদে। এই ভাবধারা অনুযায়ী নারীরা সন্তানের জননী এবং যৌনতার ধারক। একই কালে স্বর্গাদপি গরীয়সী এবং নিছক যৌনবস্তু। শুধু পুরুষেরা নয়, নারীরাও এ চোখেই নিজেদের দেখে থাকে।”
“বাঙালির কালচার প্রীতি—তার সাহিত্য, প্রেম, যাত্রা-থিয়েটার সিনেমার আধুনিকতা—বাঙালির প্রগাঢ় বিপ্লব, প্রবণতা—এই সবেরই তলে তলে রয়েছে এই নির্লজ্জ—ঋণং কৃত্বা ঠাট বজায় রাখার প্রবণতা।”
“বাঙালি প্রেক্ষাগৃহে দর্শক নাটকে আশা করে বিনোদন। নিজের সম্বন্ধে চিন্তা, রাগ, লজ্জা, ঘৃণা হতে পারে এমন বিষয় তার একেবারেই পছন্দ নয়।”
“বাঙালি লেখক ভালো গল্প লিখতে পারে, বাঙালি কবি ভালো কবিতা লিখতে পারে, কিন্তু সেই স্তরের নাটক কোনো বাঙালি নাট্যকার লিখতে পারে না, তার নিশ্চয়ই কোনো গূঢ় সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক কারণ আছে। — জীবনকে ও সমাজকে মোটামুটি অবিকৃত ভাবে বর্ণনা করতে পারলেই ভালো গল্প উপন্যাস লেখা যায়। কিন্তু আধুনিক নাটক লিখতে যে প্রকরণের প্রয়োজন হয় তা হল মননের দ্বারা জীবনের ও সমাজের বিশ্লেষণ।”
“আধুনিক নাটক এমনই একটি মায়ামুকুর, যে মুকুরে দর্শকদের দেখান হয় তাদের নিজেরই অসুন্দর চেহারা।”