শ্রীমৎ কেশবচন্দ্র সেন ১৮৩৮ নভেম্বর মাসে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বাংলার হিন্দু সমাজের নবজাগরণের ক্ষেত্রে এর বিশেষ কৃতিত্ব রয়েছে। ইনি ব্রহ্মানন্দ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। এবং ব্রহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন ধর্ম সংস্কারক ও সময় সংস্করণ। অবশেষে ইনি ১৮৮৪ সালের জানুয়ারি মাসে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এনার কিছু উপদেশ নিচে উল্লেখ করা হলো।-
“সামাজিক দুর্দশা দূরীকরণে শ্রেষ্ঠ সমাধান হলো শিক্ষা। শিক্ষা শুধু বুদ্ধিগত চর্চা ও বস্তুগত উন্নতি ঘটাবে না, মানবচরিত্রের বিশুদ্ধিকরণেও সক্রিয় থাকবে। কারণ নৈতিকতাবিহীন বিদ্যার্জন যেমন বিপদজনক তেমনই অভিশপ্ত।”
“শিক্ষকগণ যদি নিজেরাই চরিত্রবান না হন, তাঁরা যতই নৈতিক শিক্ষা দিন, কাজ কিছুই হবে না। দুশ্চরিত্র শিক্ষক যদি একটিও হয়, তার কুপ্রভাবে নষ্ট হবে শত শত শিক্ষার্থীর জীবন ।”
“প্রকৃত ‘সেবা’র সংজ্ঞা হলো মানবিকতাবোধে অহং-এর বিসর্জন, এবং সেই নিবেদিত আপন অস্তিত্বকে সমগ্র মানবজাতির অস্তিত্বে একীভূত করে সক্রিয় করা।”
‘সত্যানুভাবে মানুষ জাগ্রত হয় পাপ-পুণ্যের অতীত (দ্বন্দ্বাতীত) চেতনায়। সত্যবোধাশ্রিত চেতনায় জাগ্রত হয় শুভবোধ। সেটিকে আশ্রয় করেই প্রকাশিত হয় সৌন্দর্য। তাই পরমসত্তাকে সংজ্ঞায়িত করা হয় ‘সত্য, শিব, সুন্দর’ রূপে।”
“প্রেমের সাধক ভগবদসমীপে নিজেকে সমর্পিত করে তাঁরই আশ্রয়ে জীবনধারণ করে। সে যেমন ভগবানে নিমগ্ন থাকে, ভগবানও তার মাঝে থাকেন। ভালোবাসার মধ্য দিয়েই দিব্যতা ও মানবিকতা পরস্পরকে বরণ করে নেয়।”
“প্রত্যেক মানুষেরই আছে মতামত প্রকাশের অধিকার, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা। কিন্তু একটি ঐক্যবিধায়ক সর্বজনীন অনুগত্যের ক্ষেত্রও চাই। যেখানে মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্বের সম্বন্ধ আশ্রয়ে সহানুভূতিশীল সক্রিয়তা প্রকাশিত হতে পারবে।”
“কৃপাময় ভগবান দণ্ডবিধান করেন, তা কর্মের নিয়মরক্ষার জন্য মাত্র নয়, বরং তিনি আমাদের ভালবাসেন ও উত্তরণ চান বলেই।”
“প্রজ্ঞাময় শাশ্বতবাণী সর্বজনীন সম্পদ। সেইগুলিতে ব্যক্ত সত্যতত্ত্বে রয়েছে মানবজাতির মনীষাগত উত্তরাধিকার। কোনোকিছুই সেই আধ্যত্মিক বাণীসমূহকে ধ্বংস করতে পারে না। কারণ সেইগুলিতে অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত আছে মানবীয় পছন্দের ইচ্ছা অনিচ্ছার ঊর্ধে ।”
“একদিকে যত পাপ, ভ্রম, কু-সংস্কারকে দাঁড় করাও, অপরদিকে যত প্রকার ভয়ানক স্বেচ্ছাচার, দম্ভ, অহংকার আছে সমস্তকে দাঁড় করাও। অবশেষে এই দুইয়ের বিরুদ্ধেই স্বাধীনতার অস্ত্র নিক্ষেপ করো। কু-রীতির প্রতি খড়্গহস্ত হও।”
“শুধু বিশ্লেষণ নয়, সমন্বয়সাধনই হোক সত্যানুসন্ধিৎসুর যোগজীবনের পাথেয়। তাহলে ক্রমেই নজরে আসবে এক মহা ছন্দময় অখণ্ড জগৎলীলা ।”
“আত্মা অসীম অবিনশ্বর সত্তা। মৃত্যু বলে আসলে কিছু নেই। এটি একটি পরিবর্তনের সূচক মাত্র। দেহাত্মবোধ মিথ্যা। শরীর হলো আমাদের (জীবনের) প্রকাশাধার মাত্র। জীবনের উৎস শরীর নয়। শাশ্বত (জীবন)-এর মধ্যেই রয়েছে আমাদের অন্তর্লোকের অধিষ্ঠান। আমরা বেঁচে আছি ভগবানের আশ্রয়ে, তাঁরই যোগসাধনে তাঁকে ভালবাসার পরমলক্ষ্যে। আমাদের আদর্শ হলো নিঃশর্ত অহং সমর্পণ।”
“সমগ্র মানব শ্রেণী একটিই প্রজাতি। ঈশ্বরকে যদি জগৎপিতা রূপে বিশ্বাস করো, তাহলে সমগ্র মানব জাতিকেই গ্রহণ করতে হবে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক ধরে। স্বরূপতঃ আধ্যাত্মিক ধর্মে কোনো ভেদ নেই, তা সর্বজনীন।”
“সৎ-চিৎ-আনন্দস্বরূপ ব্রহ্ম, অখণ্ড, অসীম, পূর্ণ, সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ সত্তা। তিনিই স্রষ্টা, বিধাতা, কৃপাময় ত্রাতা ভগবান। তাঁর অস্তিত্ব নিয়ে শুধু শুনে বা জেনে রাখলে লাভ নেই। আমি যদি আমার হৃদয়ের গভীরে সেই সর্বব্যাপী অস্তিত্বকে পিতা, মাতা, বন্ধু, সখা, পথপ্রদর্শকরূপে অনুভব না করতে পারি, তাহলে সেই জ্ঞানে লাভ কী?”
“আস্তিক্যবোধ নিয়ে যায় সদাচরণে। এই সদাচরণই প্রকৃত ভগবৎ সেবা। প্রকৃত আস্তিক ব্যক্তি যেখানেই যায়, তার সঙ্গে থাকেন ভগবান, তার গন্তব্যস্থল মন্দিরই হোক বা বাজারই হোক। – আস্তিক্য বোধ শুধু শুভ মূল্যবোধে বাঁচতেই শেখায় না, তা শান্তিতে চিরবিদায় নিতেও শেখায়। আস্তিক্যবোধই ধর্মাশ্রয়ী জীবনের ভিত্তি, – জাগতিক মোহবদ্ধতা ছেড়ে বাইরে যাওয়ার দ্বার, যার মধ্য দিয়ে আমরা প্রবেশ করতে পারি দিব্যচেতনার রাজ্যে।”
“জাগতিক সমস্ত ছোট বড় আপেক্ষিক সত্যের চেয়ে অনন্তগুণে অধিক সত্য পরমাত্মা, শুদ্ধ ভক্তের চেতনায় প্রকটিত থাকেন প্রত্যক্ষভাবে। মানবকল্যাণ সাধনে ভক্ত মহামানবগণ এই জগতে আসেন ভগবদ্ প্রেরিত হয়ে। তাঁদের প্রত্যেকের শিক্ষায় থাকে এক একটি উচ্চ, মহৎ ভাবের দিগ্দর্শন। জগদ্গুরু ভগবানই আমাদের গুরু, (এইভাবে) সর্বদাই তিনি শিক্ষা দিয়ে চলেছেন।”