বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায় ১৮৯৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বর্তমানের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নদিয়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ইনি একদিকে ছিলেন যেমন কবি ও সাংবাদিক তেমনি অপরদিকে ছিলেন একজন ভারতীয় মুক্তিযোদ্ধা। অবশেষে ইনি ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এনার কিছু উপদেশ নীচে উল্লেখ করা হলো।
“এই যে আপনাকে দিকে দিকে দেশে দেশে ব্যাপ্ত করিয়া দেওয়া, সমস্ত বিশ্বের নাড়ীর স্পন্দনকে নিজের মধ্যে অনুভব করা, ইহাই তো ধর্মের প্রাণ—ইহারই নাম বাঁচা। আর যা কিছু তাহাকে বাঁচা বলে না, তাহাকে বলে ‘টিকিয়া থাকা’।”
“বাঘিনী ত্যাগ করতে পারে তার শিকারকে – কিন্তু মেয়েদের পক্ষে ভালোবাসার মানুষকে ত্যাগ করা অসম্ভব। আর নারী যখন কোমল দুটি বাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরে পুরুষের কণ্ঠ, সে বাহুর বাঁধনকে এড়িয়ে যেতে পারে এমন পুরুষ সত্যিই দুর্লভ। মেয়েদের কাছ থেকে মুক্তি পাবার জন্য পুরুষ নিজের সঙ্গে নিজের যে সংগ্রাম – এই সংগ্রামের মতো করুণ নাট্য বিরল।”
“নিজেকে আমরা বড্ড বেশি ভালোবাসি কিনা তাই দর্পণ আমাদের জীবনে এতখানি স্থান অধিকার করে আছে।”
“নারী হচ্ছে প্রকৃতির হাতের কলকাঠি আর পুরুষ হচ্ছে নারীর হাতের কলকাঠি। প্রকৃতি নারীকে দিয়ে সৃষ্টির ধারা অক্ষুণ্ণ রাখতে চায়, আর প্রকৃতির সেই আদেশকে শিরোধার্য করে নারী। খুঁজছে পুরুষের সাহচর্য।”
“ভালোবাসার ঔচিত্য-অনৌচিত্য বিচার করবার জন্য সাধারণ কোনো মাপকাঠি থাকতে পারে না। যা এদের পক্ষে উচিত তা অন্যের পক্ষে অনুচিত। এ হচ্ছে মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত সমস্যা। পুরুষ যখন নারীকে কামনা করে—সে কামনা হল তার ব্যক্তিগত সাময়িক খেয়াল। নারী যখন পুরুষকে কামনা করে—সে কামনার পিছনে থাকে সমস্ত প্রকৃতির দুর্জয় সংকল্প। পুরুষের ব্যক্তিগত খেয়াল বিশ্বপ্রকৃতির সংকল্পের তুলনায় অনেক দুর্বল। নারীর তুলনায় পুরুষ এইজন্যই শক্তিহীন—দেহের দিক থেকে নয়, হৃদয়ের দিক দিয়ে। দুজনের মধ্যে লড়াইয়ে পুরুষের জয় সর্বত্র।”
“মানুষের মধ্যে প্রাণের উৎস যেখানে শুকাইয়া আসে পুঁথির পরিমাণ সেখানে বাড়িয়াই চলে।”
“ইন্দ্রিয়ের এবং কামনার জ্ঞানের এবং অনুভূতির সমস্ত দরজা জানালাকে যেখানে আমরা খোলা রাখি সেখানেই শুধু জীবনের প্রতিদিনের সহস্র আনন্দকে আমরা আস্বাদন করতে পারি।”
“শিশু যেমন করে হাঁটতে শেখে মানুষকে তেমনি করে মরতে শিখতে হবে—অত্যন্ত সহজে এবং অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে।”
“মেয়েরা যাকে ভালোবাসে তাকে আপনার করে রাখতে চায়; আর কেউ তাকে দখল করুক- -এটা কিছুতেই তারা বরদাস্ত করতে পারে না। এই জন্য তাদের সব চেষ্টা থাকে, ভালোবাসার মানুষটিকে যেন আর কেউ চিলের মতো ছোঁ মেরে না নিয়ে যায়। যক্ষের ধনের মতো তাকে দুহাতে আগলে রাখে ৷ মজার ব্যাপার হচ্ছে মেয়েরা ভালো না বাসলেও অনেক পুরুষের ওপরে নিজেদের দখল ছাড়তে চায় না। পুরুষের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য তাদের মন এতই কাঙাল ৷ যাকে তারা ভালোবাসে না—তার কাছে থেকেও ভালোবাসার অর্ঘ্য নিতে তাদের মনে কুণ্ঠার উদয় হয় না ।”
“যাহা সহজ তাহা ফাঁকি, যাহা কঠিন তাহাই সত্য, মানুষ দুর্বল, সত্যপথে চলিবার বেদনাকে এড়াইবার জন্য সে সহজেই লোভ দেখাইয়া আপনাকে ফাঁকি দিবার চেষ্টা করে । মনের যত রকম ব্যাধি আছে তাহাদের সকলেরই মূলে রয়েছে এমন কোনো গোপন কথা যাকে মরে গেলেও আমরা প্রকাশ করতে পারিনে।”
“পুরুষের মাঝে যাহা রমণীয় সব রমণীর দান।”
“পুরুষের আত্মপ্রকাশ কোনো ব্যক্তির অপেক্ষা করে না। গান্ধি অথা বুদ্ধ যখন ত্যাগ করেন তখন কোনো ব্যক্তির প্রেরণা থাকে না সেই ত্যাগের পিছনে। একটা নৈর্ব্যক্তিক আদর্শ তাদের পাগল করে নিয়ে যায় সত্যের পথে। মেয়েরা কিন্তু যখন কোনো আদর্শের পিছনে চলে তখন সেই চলার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে ব্যক্তিবিশেষের প্রতি অনুরাগ, কোনো ব্যক্তি নেই, শুধু আদর্শ আছে—এমন অবস্থায় মেয়েদের প্রাণ আদর্শের আহ্বানে কদাচিৎ-দেয় সাড়া।”
“প্রাপ্তির মধ্যে আনন্দ নেই, আছে কেবল ক্লান্তি।”
“হে গণতন্ত্র, আমাকে দিয়ে ফলাও তোমার সোনালি ফসল।”
“পুরুষ যখন ভোগের নেশায় পাগল হয়ে নারীকে চায়— সে চাওয়ার প্রকৃতি একরকম। নারী যখন সৃষ্টির বেদনায় অধীর হয়ে পুরুষকে চায়—সে চাওয়ার প্রকৃতি আর একরকম, পুরুষের চাওয়া নারীর চাওয়াকে বিচলিত নাও করতে পারে—কিন্তু নারীর চাওয়া মহাদেবের মনকে টলিয়ে দেয়।”