স্বামী ভবেদানন্দ ১৮৬৬ সালের অক্টোবর মাসে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এবং পৃথিবীতে তিনি প্রায় ৭৩ বছর জীবন অতিবাহিত করে ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তবে তার কিছু বাণী এখনো পর্যন্ত মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়। ওগুলি সম্পর্কে নিচে উল্লেখ করা হলো।
“যেখানেই যুক্তিহীন আচার প্রথা, ক্রিয়াকাণ্ড প্রবল হয়ে ওঠে সেখানে ধর্মের আসল রূপ ঢাকা পড়ে যায়, তখন ধর্মের নামে নানারকম ভ্রান্ত বিশ্বাস ও কুসংস্কারই প্রবল হয়ে দেখা যায়। তখনই জনসাধারণ বিচার বুদ্ধি হারিয়ে….বিভ্রান্তিবসে বিশ্বাস করে এইসব আড়ম্বরই ধর্মজীবন যাপনের প্রধান উপায়। এরকম ভ্রান্তি মানুষকে আসল ধর্মের আদর্শ থেকে সরিয়ে নিয়ে বিপথগামী করে।”
“সাধন ভজনের বিষয়ে সকল উপদেশ জনসাধারণের কাছে প্রকাশ করবার নয়।”
“ব্যক্তিরূপ জীবের দেহের বিনাশ হয়, দেহ অনিত্য। আত্মা, অবিনাশী নিত্যবস্তু সচ্চিদানন্দস্বরূপ।…. মানুষের নিজের প্রকৃত স্বরূপের দিকে নজর নেই। সেভাবে এই রক্ত-মাংসের দেহটাই ‘আমি’, ‘আমি অমুকের সন্তান’ – এইজন্যই তো মানুষের এত শোক, দুঃখ, অশান্তি, এত যন্ত্রণা। উপলব্ধি করতে হবে ‘আমি’ জন্ম মৃত্যুহীন আত্মা, আমি জীব গ্রুপে ঈশ্বরের সন্তান বা অংশ। এই উপলব্ধি না হওয়া পর্যন্ত শান্তি হয় না, এবং দূর হয়না ভব-যন্ত্রণা।”
“এমন অনেক ব্যক্তি আছে যারা নিজেদের মহান ও সবচেয়ে বুদ্ধিমান মনে করে এবং অনুচরবর্গ সংগ্রহ করে বেড়ায়। কেবলমাত্র বাক্যবাগিশ কখনো প্রকৃত নেতা হতে পারে না। কেউ যদি প্রকৃত ত্যাগী না হন, তবে খুব বলতে বা লিখতে পারলেই তিনি নেতা হতে পারেন না। নাম যশের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও সার্থবসীভূত নেতা কখনো সফলতা লাভ করতে পারেন না। প্রকৃত নেতা হতে হলে চরিত্রবান ও নীতি পরায়ণ হওয়া আবশ্যক। নতুবা তিনি নিজেকে ও অন্য সকলকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাবেন। যিনি আধ্যাত্ম্য ভাবাপণ্য নন, তিনি কখনো সার্থক নেতা হতে পারেন না
মনের নিয়ন্ত্রণ না হলে চিন্তা ও ধারণা, ব্রত সাধনা কিছুই হয় না। হৃদয়ের কোনখানে কি শক্তিহীন ও ক্ষীণভাব আছে তা সন্ধান করে বের করতে হয়। মনঅন্বেষণ না করলে হৃদয়ের অসচ্ছলতা ধরতে পারা যায় না। হৃদয়কে সবসময় বিচারশীল করতে হবে যাতে আমরা ঠিক ও ভুলের পার্থক্য বুঝতে পারি। তাই বিচার ও তপস্যা দু-ই একসঙ্গে দরকার।”
“অবিদ্যা মানে ” অর্থাৎ যে অবস্থায় মানুষ নিজের দিব্য স্বরূপকে জানেনা তাকেই ‘অবিদ্যা’ বলে।
“হৃদয়ের অন্তরে বিভিন্ন ধরনের অভিলাষ, ইচ্ছা লুকিয়ে থাকে। আগে থেকেই অসংখ্য চিন্তাভাবনা হৃদয়ের ভেতর গভীরভাবে ঘনীভূত হয়ে থাকে। এই সব চিন্তাভাবনা থেকে মনকে একেবারে নিষ্কৃতি দিতে না পারলে মনকে গভীর চিন্তায় স্থির করা যায় না। যারা আবেগের দ্বারা অভিভূত তারা সংযোগ-সাধনের মালিক নয়। চিন্তা-ভাবনা যখন ইন্দ্রিয়ের দেশে ছড়িয়ে একেবারে অতীন্দ্রিয়লোকে স্থির হয়, তখনই বিদ্যানুভুতির শুরু।”
“মুক্তি অর্থে আত্মদর্শন। ‘আমি’ কে জানতে পারলেই ঈশ্বর লাভ হল। নিজের ভেতর ঈশ্বরকে পেলে, বাইরেও তাকে পাওয়া যায়।”
“মনের সঙ্গে বিশ্বস্রষ্টার অবিচ্ছিন্ন মিলনকে ‘যোগ’ বলে। ঈশ্বরকে পাওয়ার জন্য যে সমস্ত ধ্যানের পথ আছে সেগুলিকেও ‘যোগ’ বলে। বিভিন্ন ধরনের আগ্রহের সাধকের জন্য নানান ধরনের শিক্ষার পন্থা অবলম্বন করা হয়ে থাকে।
“ব্রহ্ম স্বরুপতঃ নির্গুণ নির্বিশেষে, তাতে মায়ার লেস মাত্র নেই। ব্রহ্মা কারণ, রূপ ও গুণের অতীত। কারণ শব্দটাই আপেক্ষিক। নির্ভুল ব্রহ্মে কারণ রূপ ধর্ম আরোপ করা হয়। যেহেতু জগৎটাকে দেখি ‘ব্যবহারিক সত্য’। মানে জগৎটাকে যতক্ষণ দেখছো ও ব্যবহার করছো ততক্ষণই সত্য। পারমার্থিক অর্থাৎ ব্রহ্মের দিক দিয়ে জগৎ অবাস্তব মাঝে কল্পিত খন্ডিত মায়িক প্রকাশ।”
“ভালোবাসার অর্থ একত্বের অভিব্যক্তি। ভৌতিক জগতে এই একত্ব হতে পারে না। দুটি মুখ কখনো সম্পূর্ণরূপে এক হয় না। আর মানসিক বা বুদ্ধি শক্তির স্তরেও আমরা সকলে সমান হতে পারি না। আধ্যাত্মিক ভূমিতেই এই একত্বের বিকাশ হতে পারে কারণ আত্মচৈতন্য রূপে আমরা অভিন্ন।… তাহলে আত্মাই জাতি বা সম্প্রদায়ভেদের স্থান কোথায়? আত্মায় জাতীয় বর্ণ বলে কিছু নাই, এটি একটি নিত্য শুদ্ধ। ধর্মই আমাদের একতা শক্তি উদ্বুদ্ধ করবে, এবং তাকে আমাদের সকল কর্মউদ্দমের ভিত্তি রূপে পরিণত করবে, নতুবা সাফল্য সম্ভব।”
“বিভিন্ন সাম্প্রদায় ভুক্ত মানুষের মধ্যে বিবাদের দ্বারা কোনদিনই কখনো উন্নতি হয়নি, বরং সব সময় ক্ষতি হয়েছে। সাম্প্রদায়িকতার জন্য মানুষ যে যার ধর্মের প্রকৃত আদর্শ ও লক্ষ্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকে না।”
“বড় বড় চিন্তাভাবনা নিত্য অনিত্য বস্তু বিচার করে তাড়িয়ে দেবে এবং ছোট ছোট বাসনা বিচারের সঙ্গে ভোগ দ্বারা ক্ষয় করবে।”
অসীম অনন্ত ব্রহ্মসত্তাই নিখিল বিশ্বের জড় ও চেতন- এই ভাবের মূলে বিদ্যমান। ইনি বিশ্বের নিমিত ও উপাদান- কারণ। যদিও ইনি এক, তথাপি ইনি নিজের সঙ্গে অভিন্ন ভাবে অবস্থিত অনির্বাচনীয়া মায়া শক্তির প্রভাবে বহুরূপে প্রতিয়মান হন। অসীম ও অখণ্ড চৈতন্যচরূপ ব্রহ্মের সঙ্গে অভিন্না ও সম স্বরূপা বলেই বিশ্বব্যাপিনী এই শক্তিও চৈতন্য স্বরুপিনি। মায়া অর্থে শূন্য নয়। মায়া ব্রহ্মের শক্তি যার সত্তা আপেক্ষিক।
“জন্ম-মৃত্যু কারও ইচ্ছাধিন নয়, কেবল ভগবানের নিয়মাধীন। যার যখন কর্ম শেষ হবে তখন তার কি ঘটবে, সে বিষয়ে চিন্তা করে কোন ফল নেই। ভগবানের উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করে কর্তব্যকর্ম করলে মনে শান্তি আসবে।
“সন্তান-সন্ততিদের বাচ্চা অবস্থা থেকেই শেখাতে হবে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলকেই সমান চোখে ভালবাসতে। তাহলে আর সামাজিক জাত পাত নিয়ে মানুষ আর ভাববে না। সবসময়ই লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যকে সৎ রাখতে হবে।”
“প্রকৃত ধর্ম কখনো যুক্তিকে অস্বীকার করে না, বরং বিজ্ঞানের সত্যান্বেষী নির্দেশ ধর্ম লাভেরও সহায়ক। যে ধর্ম কোন ব্যক্তিকে, পুস্তকে বা সম্প্রদায়ে আবদ্ধ তা কখনো সত্য তত্ত্বের সন্ধান দিতে পারে না।”
“ঈশ্বরের গুণগান করার নির্দিষ্ট কোন স্থান-কাল-পাত্র নেই। যখনই মনে হবে এবং যেখানেই মনে হবে তখনই গুণগান করতে হবে।”
“জড় দেওয়ার বিষয়ে আর চৈতন্যময় ‘আত্মা’ জ্ঞাতারূপ বিষয়ী। গাতা আত্মা বা বিষয়ী আছে বলেই জ্ঞেয় বিষয় বা অনাত্মপদার্থের বিদ্যমানতা সম্ভাব্যর। জড় হতে কখনো জ্ঞাতার উৎপত্তি হতে পারে না।”
“চিন্তাভাবনা এবং একই বিষয়ে ফেল ধারণা সমস্ত বিষয়েরই সাফল্যের প্রধান চাবিকাঠি। ধারণা শক্তি এবং আধ্যাত্বিক শক্তি না থাকলে কোনদিনই কোন ব্যক্তি নিজস্ব বিদ্যায় সাফল্য অর্জন করতে পারত না।”
“সাম্প্রদায়িকতার মধ্যে আবদ্ধ থাকলে ধর্ম কখনোই লাভ হয় না। কারণ সাম্প্রদায়িকতা হচ্ছে মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিকারী একটি ধারণা, যেখানে নাই কোন যুক্তি নাই কোন সঠিক সিদ্ধান্ত। ধর্মকে পরিপূর্ণভাবে আয়ত্ত করতে হলে মানুষকে সাম্প্রদায়িকতার গোঁড়ামি ও যুক্তিহীনতাকে একেবারে পরিত্যাগ করতে হবে। কোনদিনই অজানা বিষয়ে বিশ্বাস করা চলবে না। ধর্মের বিষয়ে সত্য অনুসন্ধানের চেষ্টা করতে হবে।”
“ঈশ্বরের সাক্ষাৎকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে হলে মনকে পরোচেতন অবস্থায় নিয়ে যেতে হবে।।”
“সহজ সরল, ন্যায় পরায়ণ ও সত্য সংযম ব্যাক্তি ধর্মকে সঠিকভাবে পাওয়ার ব্যাক্তি। যে ব্যক্তি নিজের মন ও ইন্দ্রিয়কে আয়ত্ত করতে পেরেছেন, সেই সমস্ত ব্যক্তি ধর্মকে উপলব্ধি করতে পেরেছেন। যতক্ষণ পর্যন্ত ব্যক্তির মধ্যে দুশ্চিন্তা ও অসৎ কর্মমূলক ধারণা থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি তার মনকে সংযত করতে পারবে না এবং ঈশ্বরকে উপলব্ধি করতে পারবে না।”
বিশ্ব জগতে সমস্ত মানুষের মধ্যেই আত্মা বিরাজমান। কেউ আমার উপকার করলো কিনা তা তা জানার কোন প্রয়োজন নাই। কিন্তু আমি সকল মানুষকেই ভালোবেসে যাবো। এই ধারণা সকলের মধ্যেই প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। কারণ আমাদের মধ্যে জাতি, ধর্ম, বর্ণের ভিত্তিতে হাজার বিভেদ থাকলেও আমরা কিন্তু সকলেই এক।”
“আসল ধর্ম সম্পূর্ণরূপে সাধন সাপেক্ষ। ধর্ম শাস্ত্রপাঠ, বিচার-বিতর্ক, আলাপ-আলোচনা কিংবা আচার নিয়ম পালন গৌণ বেপার। সমস্ত ধর্মের কয়েনের দুটি দিক রয়েছে, যার মধ্যে একটি হল মুখ্য এবং অপরটি হল গৌণ দিক। বিভিন্ন সম্প্রদায়গত মতবাদ, বিশ্বাস এবং অবিশ্বাস বিধি, আচার ব্যবহার, পূজা-পার্বণ সহ সমস্ত পৌরাণিক কাহিনী এবং ধর্ম প্রচারের জন্য পালনীয় দিক – এই সব কিছুই ধর্মের প্রধান দিক নয় গৌণ দিক।”
“ঈশ্বরকে উপলব্ধি করতে হলে ঋষি মনীষীর মত ব্রহ্মজ্ঞ গুরুর উপদেশ ও যোগাশাস্ত্রের নির্দেশ মতো ধ্যান ধারণার অভ্যাস করা প্রয়োজন। এর জন্য মানবকে যথার্থ ত্যাগ করতে হবে এবং গভীর মনোযোগের সহিত সাধনা করলে অবশ্যই সাধক ঈশ্বরকে প্রাপ্ত করতে পারবে। আর এই ঈশ্বর প্রাপ্তির মাধ্যমেই ব্যক্তির জীবনে কল্যাণময়ী মুক্তি ও অনন্ত শান্তি লাভ করে।”
“ঈশ্বর অনাদি অনন্ত অখন্ড প্রাণস্বরূপ। যিনি সমস্ত মানুষের ভিতরে হৃদয়ের বাইরে সব জায়গাতেই উপস্থিত আছেন। ঈশ্বরকে জানার জন্য তোমার চারপাশে যা কিছু রয়েছে তাকে তুমি দেখো। সৎকর্ম করতে করতে আত্মা পরিশুদ্ধ হলেই ঈশ্বর লাভ হবে।”
“শুধুমাত্র সংসার পালনের মাধ্যমেই মনে শান্তি ও আনন্দ আসে না। মনের পরিপূর্ণতা আছে তখনই যখন ঈশ্বরকে পাওয়ার জন্য সাধনা করা হয়।”
“আবিদ্যা গ্রস্থ জীবন শরীরের তিনটি জালে আবদ্ধ হয়ে নিজেকে কর্তা বা ভক্তা বলে মনে করে। যতক্ষণ পর্যন্ত কর্তৃত্ব ও ভক্তিৃত্ব এই দুই বোধ থাকে, কতকাল পর্যন্ত জীব নিজের কর্ম নিয়ে চলে এবং তার ফল ভোগ করে।”
“নিজের ইষ্ট দেবতার প্রতি চিন্তাধারা যখন তৈল ধারার মতো অবিশ্লান্তভাবে প্রবাহিত হয়, তখন তাকে ‘ধ্যান’ বলে। মন যখন ইষ্ট দেবতাই পরিপূর্ণ হয়ে যায় তখনই দেবতার ‘দর্শন’ হয়।”
“শ্রীভগবান সকলকে চালাচ্ছেন। তিনি পরম স্রষ্ঠা এবং পরমদাতা। পৃথিবীতে তুমি তার দাস এবং তিনি হল তোমার প্রভু। তারই তৈরি সংসারে তুমি প্রতিনিধি মাত্র। তাই যার তৈরি সংসার তিনিই সংসারের অভাব ও ভাব দেখে নেবে। তুমি তোমার কর্ম করে যাও।”
“মোক্ষ বা স্বাধীনতা কেবলমাত্র আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকে না। অপরপক্ষে তা থেকে সামাজিক রাজনৈতিক নৈতিক ও মানসিক স্বাধীনতাও লাভ হয়ে থাকে।”