Nolini Kanta Gupta Quotes | নলিনীকান্ত গুপ্তের ৩০টি মোটিভেশন বাণী

নলিনীকান্ত গুপ্ত ১৮৮৯ সালের জানুয়ারি মাসে বর্তমান বাংলাদেশের রংপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। একদিকে ছিলেন কবি ও দার্শনিক এবং অপরদিকে ছিলেন একজন ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী। অবশেষে ইনি ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ইনার কিছু উপদেশ নীচে উল্লেখ করা হলো। 

Nolini Kanta Gupta Quotes
Photo from Pixabay

“শান্তি অন্তরের ইন্দ্রিয়কে, বাহিরের ইন্দ্রিয়কে উদার প্রসারিত করিয়া ধরে, আর এইজন্যই সেখানে আসিয়া ধরা দেয় অন্তরের অসীমের স্বাচ্ছন্দ্য। শান্তির মধ্যেই গাঢ় হইয়া জমিয়া উঠে একটা আত্মস্থ সামক্ষ্য শান্তি স্বচ্ছতা দৃষ্টিকে লইয়া চলে গভীর হইতে গভীরে।”

“জগতে যে একটি মাত্র সত্য বা সুন্দর বা মঙ্গল আছে তাহা নয়; একটি বিশেষ সত্য, সুন্দর, মঙ্গল যে আর সকলের উপরে, তাহাও নয়। আছে অনেক সুন্দর মঙ্গল—প্রত্যেকেই নিজের নিজের ধর্মে মহান।”

“বিচার দেয় খণ্ডের অনুভূতি, এক সময়ে একটি জিনিসের এক রকম জ্ঞান ; কিন্তু বিবেকে পাই গোটার অনুভূতি, এক সময়ে এক জিনিসের বা বহু জিনিসের বহুল রূপের জ্ঞান—এক বহু বহুধা’র সমন্বয় সম্মিলন হইতেছে বিবেকের জ্ঞান।”

“জ্ঞানের আছে দুইটি বৃত্তি—বিচার ও বিবেক। আমাদের দোষ বিচারকেই সর্বেসর্বা করিয়া তুলি আর বিবেককে এক পাশে ফেলিয়া রাখি, নষ্ট হইতে দিই। কিন্তু বিবেকই জ্ঞানের প্রতিষ্ঠা জ্ঞানের গোড়া ঘেঁষা বৃত্তি ; আর বিচার হইতেছে জ্ঞানের গৌণ বৃত্তি।”

“বিষয় হিসাবে, আমরা চাহিতেছি বটে জ্ঞান আরও জ্ঞান, কিন্তু জ্ঞানের বস্তু অপেক্ষা আমাদিগকে বেশি অনুপ্রাণিত করিতেছে অনুসন্ধান, অনুসন্ধানের আবেগ জ্ঞানের সাধক হইয়াও, এই উপলব্ধিটি, আমরা কখনোও ছাড়াইয়া উঠিতে পারি না যে, সকল জ্ঞানই পরিশেষে আপেক্ষিক, সকল জ্ঞানই সাময়িক এবং দেশিক ; তবুও চাহিয়াছি সেই জ্ঞান, একটা চির অতৃপ্তির জের টানিয়া ক্রমাগত চলিয়াছি এক জ্ঞান হইতে আরেক জ্ঞানে। জানি চিরন্তন অনন্ত সত্য কিছু নাই—আছে আজকার এখনকার সত্য, তাহার স্থানে আসিবে কালিকার ওখানকার সত্য—এইরকম সত্যের ক্ষণিকের কাহিনি হইল আর সত্য।”

“শিশু স্বভাবতই কৌতূহলী অর্থাৎ অনুসন্ধিৎসু, জিজ্ঞাসু, তাহাকে ছাড়িয়া দিতে হইবে, চালাইয়া লইতে হইবে এই জিজ্ঞাসার পথে। শুধু ভিতর হইতে যে জিজ্ঞাসা আপনা হইতে আসে, তাহাতেই কিন্তু আবদ্ধ থাকিলে চলিবে না, শিশুর মনে ক্রমে নূতন নূতন জিজ্ঞাসাও তুলিয়া দিতে হইবে। অজানা অপরিচিত জিনিস তাহার চোখের মনের সম্মুখে ধরিয়া দিতে হইবে।”

“অর্থ একাত্মানুভূতি—কোনো বাস্তব সত্য যখন লাভ করি সেই বস্তুর সহিত একাত্ম হইয়া।”

“বিচার সত্যকে আবিষ্কার করে না; বিবেকই সত্যকে আবিষ্কার করে, বিচার পরে আসিয়া তাহার “কেন, কিরূপ” বুঝাইয়া দেয়, প্রমাণ সংগ্রহ করে।”

“আবার অন্যদিকে এমন অত্যুক্তিও করা চলে না যে কবি ও যোগী এক ও অভিজ্ঞ কাব্যরচনা ও যোগ-সাধনায় পার্থক্য নেই, কবির তবুও হল বাঙ্ময় জগৎ এবং সেটি মানসলোকের অন্তর্ভুক্ত। কবির যে অন্তরাত্মার জ্যোতি তা এই বাঙ্ময় মানসলোককে ভাস্বর, অধ্যাত্মপ্রবণ করে তোলে।

কিন্তু যোগীর ক্ষেত্র আরো বিস্তৃত ও বস্তুগত—কারণ যোগীর প্রয়াস প্রাণে ও দেহে অধ্যাত্মের আলো প্রজ্বলিত করা। কবি এই প্রয়াসের আরম্ভ হতে পারেন। সহায় হতে পারেন কিংবা শেষে জয়ের প্রকাশ বা ঘোষণাও হতে পারেন, কিন্তু কবি যোগীকে সরিয়ে তার স্থান গ্রহণ করতে পারেন না—যোগী হতে গেলে যে কবি হতেই হবে তা নয়।”

“মহাকাব্যের যুগ চলিয়া গিয়াছে, আমরা আধুনিকেরা বলিয়া থাকি। কারণ দিই এই যে, বাহ্য ঘটনা-পরম্পরার দিকে শিল্পী আর মন দিতে পারেন না, আধুনিক শিল্প অন্তর্মুখী, তিনি বলিতে চাহেন ভিতরের জগতের রহস্যের কথা ; তাই আজকাল হইতেছে বিশেষভাবে গীতিকাব্যের যুগ। আরো একটা কারণ এই, মহাকাব্য রচনা করতে প্রয়োজন চিত্তের মধ্যে যে অবসর, যে স্থৈর্য-ধৈর্য, যে টানা দম তা আধুনিকের নাই।”

“সকল শিল্পের সত্য হইতেছে আত্মা, রস হইতেছে প্রাণ, আর রূপ হইতেছে দেহ।”

“জীবনের ছন্দ এক, শিল্পের ছন্দ আর এক; শিল্পের মধ্যে জীবনকেই যদি মূর্ত করিয়া ধরিতে চাই, তবুও জীবনের গতিভঙ্গীকে হুবহু শিল্পের গতিভঙ্গীর মধ্যে তুলিয়া ধরিতে পারি না। জীবনকে শিল্পের মধ্যে তুলিয়া ধরিতে হইলেই দরকার একটা রূপান্তর পাশ্চাত্যে ইহার নাম দিয়াছে Stylisation—এই রূপান্তরের অর্থই শিল্পগত সৌন্দর্য।”

“উপনিষদের কবি পূর্ণমাত্রায় যোগী ও ঋষি ছিলেন। উপনিষদ কবিত্ব হিসাবে যতখানি উৎকৃষ্ট, সাধনার মন্ত্র হিসাবেও ততখানি গ্রহণীয়। কবি ও যোগী এখানে এক হয়ে, উভয়ে উভয়ের অভিব্যক্তি হয়ে প্রমূর্ত—পরস্পরং ভারয়ন্তঃ।”

“ইন্দ্রিয়কে দমনে রাখিতে যাইয়া ইন্দ্রিয়ের সত্য ভোগকে নির্বাসিত করিব কেন? ইন্দ্রিয়ের যে বাহ্য বিক্ষোভ তাহার ভয়ে ইন্দ্রিয়ের দেবতাকে অস্বীকার করা সত্যানুভূতিরই অন্তরায়।”

“সেকাল ও একালের ব্যবধানটি এককথায় নির্দেশ করিতে হইলে বলিতে পারি যে, সেকালের শিল্পীরা মুখ্যত চাহিতেন সৌন্দর্য, আর একালের শিল্পীরা চাহেন সত্য। সুন্দর একখানি রূপ গড়িয়া তোলা ছিল প্রাচীন শিল্পীর সকল প্রয়াস, আধুনিকের একমাত্র যত্ন সত্যকে, নিছক সত্যকে প্রকাশ করিয়া ধরা। এই আকৃতি ও প্রকৃতি সম্পূর্ণ বিভিন্ন, এমনকি হয়তো বিপরীত ধরনের হইয়া পড়িয়াছে।”

“কবিদের আদি অর্থ ছিল ঋষি। কিন্তু এখন কবিকে আবার ফিরে আর্য চেতনায় উঠতে হবে নবযুগের নব সৃষ্টির জন্য। জীবনের সাধনায় যে ঋষি ব্ৰহ্মবিৎ ব্ৰহ্মভূত শিল্পের রচনায় তিনিই হবেন পরম কবি।”

“সত্যের সাধক যিনি তাঁহাকে বলি ঋষি, সুন্দরের সাধক যিনি তাঁহাকে বলি কবি, আর শিবের বা মঙ্গলের সাধক যিনি তাঁহাকে বলি নবী। ঋষি সত্যের দ্রষ্টা, কবি সুন্দরের স্রষ্টা, নবী মঙ্গলের হোতা। ঋষির আছে জ্ঞানদৃষ্টি, কবির রসানুভূতি, আর নবীর তপঃশক্তির আকুতি। ঋষির আসন মস্তকে, কবির আসন প্রাণে, আর নবীর প্রতিষ্ঠা হৃদয়ে। অথবা আরো বলিতে পারি, ঋষি হইতেছেন সময় পুরুষ, নবী ইতেছেন চিন্ময় (তপোময়) পুরুষ, আর কবি হইতেছেন আনন্দময় পুরুষ।”

“শিক্ষার মধ্যে তিনটি স্তর বা ধারা আছে। প্রথম, বিষয় অধিকার ও দ্বিতীয়, বৃত্তির চর্চা, আর তৃতীয়, মনের গড়ন ঠিক করা, সামর্থ্য বাড়ান। প্রথম হইতেছে বিশেষ বিশেষ বিদ্যায় পারদর্শী হওয়া, তৎসম্বন্ধে যত তত্ত্ব ও তথ্য আছে তাহা জানা যা আবিষ্কার করা। দ্বিতীয় হইতেছে মনের বিশেষ বিশেষ বৃত্তিকে মাজিয়া ঘষিয়া তীক্ষ্ণ ও পুরিপুষ্ট করিয়া তোলা—যেমন স্মৃতির শক্তি অথবা বিচার-বিতর্কের শক্তি অথবা সাজাইয়া গুজাইয়া ধরিবার শক্তি।

আর তৃতীয় হইতেছে কোনো বিশেষ বিষয়ে বিদ্বান বা শাস্ত্রজ্ঞ হওয়া নয়, কিংবা কোনো বৃত্তি বিশেষ উৎকর্ষ লাভ নয়, কিন্তু মনের গোড়াটি, মোটা মস্তিষ্কটি সতেজ ও শক্তিমান করিয়া তোলা। পূর্ণ শিক্ষার এই তিনটি অঙ্গেরই দরকার, তবে তাহার প্রণালী হওয়া উচিত বাহির হইতে ভিতরে ঢুকিবার চেষ্টা নয়, কিন্তু ভিতর হইতে বাহিরে আসা ।”

“হাসির সৌন্দর্য রূপে, অশ্রুর সৌন্দর্য রসে।”

“বিবেকের মধ্যে ক্রম অর্থাৎ ধাপে ধাপে চলা নাই, কিন্তু বিচার চলে একটা ক্রমানুসরণ করিয়া।”

“রূপ ও রস, এই দুই লইয়া আর্ট বা সৌন্দর্য সৃষ্টি। রস হইতেছে বস্তুর অন্তরাত্মার আনন্দ, আবেগ, আহ্লাদ ; আর এই রসের সম্যক প্রকাশ হইতেছে রূপ। রস যাহাই হোক না তাহাকে ফুটাইয়া ধরিতে পারিলেই রূপের সার্থকতা—এ কথা সত্য বটে,

কিন্তু রূপ তো কখনো রসের প্রভাব একান্ত উড়াইয়া চলিতে পারে না। রস আলাদা উপভোগ করিব, রূপ আলাদা উপভোগ করিব, মানুষের চেতনার এই ভাগাভাগি দল স্বাভাবিক নয়। মানুষের রূপ-রসানুভূতি একটা অখণ্ড চেতনা।”

“সমাজের বিধিব্যবস্থা নিয়মকানুন ব্যক্তিজীবনকে নিয়মিত নিপীড়িত করিতেছে। কিন্তু মানুষের আছে কতগুলি স্বাভাবিক প্রেরণা, অন্তরের টান, সেগুলির তৃপ্তির পথে দাঁড়ায় এইসব বিধিব্যবস্থা, নিয়মকানুন।”

“তর্কবুদ্ধি গতানুগতিকতাকে এমন আঁকড়াইয়া ধরে— বিশেষতঃ গতানুগতিকের বাহা।”

“ঘটনা বা রূপের দিকটা—যে তাঁহার সহিত হুবহু না মিলাইয়া লইতে পারিলে নূতন সত্যকে সে আমলই দিতে চায় না। তারপর দ্বিতীয়ত মাথার চর্চা যেখানে অত্যধিক পরিমাণে হইয়াছে, সেখানে প্রাণশক্তির কর্মেন্দ্রিয়ের সামর্থ্য ততই যেন কমিয়া গিয়াছে। কাজেই বুদ্ধিমানদের লইয়া বৃহৎ কর্ম কিছু করা সুকঠিন।

এই সত্যকথা শুষ্ক তর্কবৃত্তি ধর্মবোধের অধ্যাত্ম উপলব্ধির অন্তরায় ; কিন্তু তাই বলিয়া এ সিদ্ধান্ত করিলে চলিবে না যে তর্কবৃত্তি না থাকাটাই হইতেছে অধ্যাত্ম সত্য লাভের সেরা উপায়। তর্কবৃত্তি অন্তরায় হইতে পারে কিন্তু প্রাণের আবেগ চিত্তের উত্তেজনাও অন্তরায়—কোনোটা কিছু বেশি, কোনোটা কিছু কম অন্তরায় তাহা নির্ণয় করা খুব সহজ ব্যাপার নয়।”

“সাহসে ভর করিয়া যদি ইন্দ্রিয়কে মুক্ত করিয়া দিতে পারি তাহার সহজ পথে অবাধে চলিতে, তবে অবিলম্বেই প্রমাণ পাইব ইন্দ্রিয়ের আছে কি অদ্ভুত প্রতিভা। সেই মানুষই বাস্তবিক ততখানি প্রতিভাবান যিনি যতখানি যন্ত্রপাতির অত্যাচারের হাত এড়াইতে পারিয়াছেন, আপন ইন্দ্রিয়কেই সজাগ শক্তিমান করিয়া তুলিয়াছেন।”

“সমাজের ব্যবস্থা এক হিসাবে যতই কৃত্রিম হউক না কেন, আর এক হিসাবে তাহা সামাজিক জীবনেরই অভিব্যক্তি। বাহিরের ব্যবস্থা যদি না কোনোরকমে এক জায়গায় আমাদের অন্তরের বস্তু হইয়া দাঁড়ায় তবে তাহার উৎপত্তি যেমন সম্ভব নয়, তাহা টিকিয়াও তেমনি থাকিতে পারে না অর্থাৎ সমাজের বিধান শুধু বাহিরের নিয়ম না, সেটা হইয়া পড়ে আমাদের অন্তরের সংস্কার।”

“কবি সৌন্দর্যকে ধরিতে চাহেন প্রকৃত প্রাণের তৃষ্ণার সহায়ে—তাঁহার বিরুদ্ধে জ্ঞানী দাঁড়াইয়াছেন সত্যকে ধরিতে নৈতিক বুদ্ধির সহায়ে। কিন্তু কবির ও জ্ঞানীর মধ্যে এই দ্বন্দ্বের প্রয়োজন নাই। সত্যকার কবি সৌন্দর্যকে ধরিবেন প্রাণের যে বিশুদ্ধ রসবোধ তাহার সহায়ে—তবে তিনি সেই সঙ্গেই সত্যকেও ধরিবেন, দিব্যদৃষ্টির সহায়ে। দিব্যদৃষ্টির উন্মেষ রসবোধে, আর রসবোধের প্রতিষ্ঠা দিব্যদৃষ্টির মধ্যে। এই ভাবেই কবি ও ঋষি এক হইয়াছেন এবং ঋষি ও কবির মধ্যে শ্রেয় ও প্রেয় অভিন্ন হইয়া দাঁড়াইয়াছে।”

“তর্ক বুদ্ধি ঊর্ননাভের মতো নিজের ভিতর হইতে সিদ্ধান্ত সব বাহির করিয়া করিয়া খাড়া করে একটা কাল্পনিক জগৎ, একটা System of theories — সৃষ্টির মূলতত্ত্ব ধরিতে গিয়া তত্ত্বের মধ্যে গিয়া সে বাঁধা পড়ে, কিন্তু মূল সৃষ্টিতে অবজ্ঞাত হইয়া একপাশে পড়িয়া থাকে।”

Leave a Reply