বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৯৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর ২৪ পরগনা জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ইনি ছিলেন একদিকে শিক্ষক এবং অপরদিকে বিখ্যাত লেখক। ইনি ১৯৫১ সালে রবীন্দ্র পুরস্কারও পেয়েছিলেন।
এনার লেখা উপন্যাস গুলির মাধ্যমে অনেক চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছিল, যেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য পথের পাঁচালী, চাঁদের পাহাড়, অ্যামাজন অভিযান ইত্যাদি। অবশেষে ১৯৫০ সালের নভেম্বর মাসে ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এনার কিছু বাণী নিচে উল্লেখ হল।-
“সমাজের বাস্তব পটভূমিতে যে রসশিল্প রচিত হয়, শিল্পীমানসের প্রকাশভূমি যাহা, তাহাই সাহিত্য।”
“প্রকৃতির রাজ্যে মানুষের যেতে হয় একাকী, তবেই প্রকৃতির রাণী অবগুন্ঠন উন্মোচন করেন দর্শকের সামনে নতুবা নয়।”
“এক-একটা সময় আসে, যখন বিদ্যুৎ চমকে অনেকখানি অন্ধকার রাস্তা একবারে দেখতে পাওয়ার মতো সারা জীবনের উদ্দেশ্য ও গভীরতা যেন মুহূর্তে জানতে পারা যায়, বুঝতে পারা যায়। শুধু সৌন্দর্যই এই বিদ্যুৎ আলোর কাজ করে মানসিক জীবনে। কিন্তু এ সৌন্দর্য বড়ো আপেক্ষিক বস্তু। একে সকলে চিনতে পারে না, ধরতে পারে না। কানকে, চোখকে, মনকে তৈরি করতে হয়, সঙ্গীতের কানের মতো সৌন্দর্য জ্ঞান বলে একটা জিনিসের অস্তিত্ব আছে।”
“যে জাতির মধ্যে সৌন্দর্যবোধ দিন দিন এত কমে যাচ্ছে, সে জাতির ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে খুব সন্দেহ হয়।”
“প্রকৃতির একটা বৈশিষ্ট্য এই যে নির্জন স্থানে প্রকৃতির এই রূপ মনে নতুন ধরনের অনুভূতি ও চিন্তা এনে দেয়।”
“যৌন চেতনার পরম রূপান্তরণ হল প্রেম। বীজ এবং ফুলের সম্পর্কের মতো কাম এবং প্রেমের সম্পর্ক অচ্ছেদ্য। কাম বলতে বুঝি জৈব মানসিক ক্ষুধা, এক ধরনের দহনক্রিয়া। এর থেকে বিচ্ছুরিত হয় যে আলো তাকে বলি প্রেম। এই আলোতে যখন কাউকে দেখি তখন তাকে বলি সুন্দর। এই সুন্দর বলতে চোখমুখের গড়ন, দেহের জৌলুস বোঝায় না। এক ধরনের অবিশ্লেষ অনুভব মাত্র। এর মূলে থাকে রক্ত-মানসের পিপাসা। দেহ নিহিত সুপ্ত কাম—চৈতন্যের জাগরণ, মন তাকে চিনে নেয়। দেহ এবং মনের পূর্ণ সায় যখন নরনারীর ভেতরে সমভূমিকে তখন প্রেম সার্থক।”
“লেখক ও কবির মধ্যে একটা সহজাত নিঃসঙ্গতা আছে।’
“জীবনটাকে আমরা ঠিক চোখে অনেক সময় দেখতে শিখিনি বলেই যত গোল বাধে। জীবন আত্মার একটা বিচিত্র অপূর্ব অভিজ্ঞতা। এর আস্বাদ শুধু এর অনুভূতিতে। সেই অনুভূতি যতই বিচিত্র হবে, জীবন সেখানে ততই সম্পূর্ণ, ততই সার্থক। সেই দিক থেকে দেখলে দুঃখ জীবনের বড় সম্পদ, দৈন্য বড় সম্পদ, শোক, দারিদ্র্য, ব্যর্থতা বড় সম্পদ মহৎ সম্পদ—জীবনকে যে চিনতে পেরেছে এ জগতে তার ঐশ্বর্যের তুলনা নাই।”
“আর্টকে বুদ্ধির চেয়ে হৃদয় দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলে বোঝা যায় বেশি।’
“সুখদুঃখ জন্মমৃত্যু সবই খেলা, দুদিনের। কিছুতেই ব্যথিত হবার কিছুই কারণ নেই। নদী বেয়ে যে শব ভেসে যাচ্ছে কে জানে হয়তো দূর কোন্ অজানা নক্ষত্রে ওর মৃত্যু নবজীবন লাভ করেছে। ওর মৃত্যুযন্ত্রণা সার্থক হয়েছে। এই বিচিত্র বিশ্বলীলার কলেই যে যাত্রী।’
“জীবনের সার্থকতা অর্থ উপার্জনে নয়, খ্যাতি প্রতিপত্তিতে নয়, লোকের মুখের সাধুবাদে নয়, ভোগে নয়—সে সার্থকতা আছে শুধু জীবনকে গভীরভাবে উপলব্ধি করার ভেতরে, বিশ্বের রহস্যকে বুঝতে চেষ্টা করবার আনন্দের মধ্যে।”
“সাহিত্য শুধু রসবিলাস নয়, জীবন সমস্যার সমাধানের গূঢ় ইঙ্গিত থাকবে যে সাহিত্যের মধ্যে তারই মধ্যে আমরা পাব কলালক্ষ্মীর কল্যাণতম মূর্তিটির সন্ধান।”
“তুমি চলিয়া যাইতেছ… তুমি কিছুই জানো না, পথের ধারে তোমার চোখে কি পড়িতে পারে। তোমার ডাগর নবীন চোখে বিশ্বগ্রাসী ক্ষুধায় চারিদিককে গিলিতে গিলিতে চলিয়াছে নিজের আনন্দের এ হিসাবে তুমিও একজন দেশ আবিস্কারক।”
“জীবনে যদি বড় দুঃখ পাও সে দুঃখ লিখে রেখে যেও উত্তরকালের জন্য। দুঃখের কাহিনি চিরদিন অমর থাকবে, কিন্তু তা চিরদিন লোকের মনে বল দেবে। পূর্ণ অন্ধকার অমাবস্যার পরই শুক্লপক্ষের চাঁদ ওঠে—দুঃখের রাত্রিতেই তারা খুব উজ্জ্বল হয়।”
“নারী প্রেমের সাধিকা হয় অতি সহজে, পুরুষ তা পারে না, নারী পাপের পথেও নিয়ে যায়, কল্যাণের পথেও নিয়ে যায়। কারণ চিত্তনদী উভয়তোমুখী, বহতি পাপায়, বহতি কল্যাণায়।”
“বহুদুরের ওই নীল কৃষ্ণাভ মেঘরাশি, ঘন নীল ; নিথর গহন আকাশটা মনে যে ছবি আঁকে যে চিন্তা জোগায় তার গতি গোমুখী গঙ্গার মতো অনন্তের দিকে, সে সৃষ্টি -স্থিতি-লয়ের কথা বলে—মৃত্যু পারের দেশের কথা কয় – ভালোবাসা বেদনা, ভালোবাসিয়া হারানো, বহুদুরের প্রীতিভরা পুনর্জন্মের বাণী।”
“সমাজ সচেতনতা লেখকের মস্ত গুণ। যিনি দেশের অভাব অভিযোগের প্রতি উদাসীন থেকে সাহিত্য রচনা করেন, তিনি নিজের কবিমানসের প্রতি অবিচার করেন। জীবনবোধের দায়িত্ব তিনি কিছুতেই এড়াতে পারেন না, জনসাধারণের প্রতিঘাত মুখর জীবনধারা হতে বহুদূরে একটি কল্পলোক সৃষ্টি করে তিনি কল্পনাবিলাস চরিতার্থ করতে পারেন, কিন্তু জীবনের ওপর তার কোনো স্থায়ী ফল ফলে না।”
“জীবনে মানুষ ততক্ষণ ঠিক শেখে না অনেক জিনিসই, যতক্ষণ সে দুঃখের সম্মুখীন না হয়।”
“সাহিত্য আমাদের পরিচিত করবে নিগূঢ় বিশ্বরহস্যের সঙ্গে, জীবনের চরমতম প্রশ্নগুলির সঙ্গে, দেবে আমাদের উদার, মৃত্যুঞ্জয় দৃষ্টি, সকল সুঃখদুঃখের ঊর্ধে যে অসীম অবকাশ ও তৃপ্তি, আমাদিগকে পরিচিত করবে সেই অবকাশের সঙ্গে এ তো সাহিত্যের একটা মস্তবড় দিক।”
“জীবন খুব বড়ো একটা রোমান্স—বেঁচে থেকে একে ভোগ করাই রোমান্স— অতি তুচ্ছতম, হীনতম, একঘ্নেয়ে জীবনও রোমান্স।”
“এই পৃথিবীর একটা Spiritual nature আছে, ফুলফল, আলোছায়া, আকাশ বাতাসের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছি বলে, শৈশব থেকে এদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের বন্ধনে আবদ্ধ বলে, এর প্রকৃত রূপটি ধরা আমাদের পক্ষে বড়ো কঠিন হয়ে পড়ে।”
“জীবনকে খুব কম মানুষই চেনে। জন্মগত ভুল সংস্কারের চোখে সবাই জীবনকে বুঝিবার চেষ্টা করে, দেখিবার চেষ্টা করে, দেখাও হয় না, বোঝাও হয় না।”